Wednesday, July 5, 2017

গ্রীক মিথের ভিলেনগণ (পর্ব - ০৩)


 গ্রীক মিথের কাহিনীগুলো আমাদের সবারই কমবেশি জানা আছে । এবার পরিচিত হয়ে নিন ভয়ংকর কিছু দানবদের সাথে । এদেরকে মূলত দেবতারা তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ব্যবহার করতেন । কাজ শেষ আবার ধ্বংসও করে ফেলতেন । প্রাচীন গ্রীকের কয়েকটি কমন চরিত্র তুলে আনার চেষ্টা।


Hydra
হাইড্রা জিউসের প্রাচীন সার্ভেন্ট । জলদানব, নয়মাথা বিশিষ্ট সরীসৃপ ট্রেইটস । বলা হয়ে থাকে হাইড্রার এক মাথা কাটা পড়লে সে জায়গায় দুই মাথা গজায় । মানে দিগুণ হারে বৃদ্ধি । এর নিঃশ্বাস এতই বিষাক্ত যে, আশে পাশে কেউ ঘেঁষতে পারেনা । লেরনা লেকের নিচে আরগলিক রাজ্যের গার্ডিয়ান হচ্ছে হাইড্রা । বারোজন সঙ্গী নিয়ে হেরাক্লেস হাইড্রাকে কর্তন করতে রওনা দেয় । লেরনা লেকের নিকটে এসে হেরাক্লেস আর তার সঙ্গীরা বিষাক্ত পয়জন থেকে বাঁচতে কাপড় দিয়ে ভালো করে নাকমুখ পেঁচিয়ে নেয় । তারপর ওরা হাইড্রার মুখোমুখি হয় । সঙ্গীরা প্রত্যেকটি মাথা লক্ষ্য করে জ্বলন্ত তীর ছুঁড়তে থাকে । এইফাঁকে হেরাক্লেস তার স্পেশাল হারভেস্টিং চেইন আর সোর্ড দিয়ে হাইড্রাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে । কিন্তু বেশিক্ষণ পেরে ওঠেনা । যখনই হেরাক্লেস হাইড্রার একটা মাথা কাটে সঙ্গে সঙ্গে আরো দুই মাথা গজিয়ে যায় । হেরাক্লেস কাটতে কাটতে দেখে আর মাত্র দুই মাথা বাকি । কিন্তু এই পর্যন্ত এসে আর পারেনা সে । এরই মধ্যে অন্যমাথাগুলো গজিয়ে যায় । হাইড্রার একমাত্র দুর্বলতা হচ্ছে, কিছুতেই তাকে এক মাথাওয়ালা হতে দেওয়া যাবেনা নইলে হত্যা করাটা দুর্ভেদ্য হয়ে পড়বে । তো যখন হেরাক্লেস ক্লান্ত হয়ে পড়ল সে তার ভাতিজাকে ডাকল । ভাতিজা বুদ্ধি দিলো মাথা কাটার পর জ্বলন্ত কয়লা দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার, যাতে আর না গজাতে পারে । সেই অনুযায়ী হেরাক্লেস আর তার ভাতিজা মিলে হাইড্রার একটা করে মাথা কাটে আর সে জায়গাটা পুড়িয়ে দিতে থাকে । এভাবে হাইড্রা হেরাক্লেস দ্বারা ধ্বংস হয় ।


Minotaur
মাইনোটরকে বলা হয় মহিষের মাথাবিশিষ্ট মানুষখেকো দানব । প্রাচীন গ্রীকের অর্ধেক মানুষ অর্ধেক ষাঁড় । রাজা মাইনস মাইনোটর থেকে তাঁর রাজ্য ও প্রজাদের ডিফেন্ড করতে ডিডেলাস আর তার পুত্র ইকারুসকে নির্দেশ দেন একটা গোলকধাঁধা তৈরি করতে । ক্রেটান লেবিরিন্থ নামক সেই গোলকধাঁধার সেন্টারে আটকা পড়ে যায় দানবটি । পরবর্তীতে কিং মাইনস তাঁর সহোদরকে সিংহাসনের অধিকার দেন । মেনে নেন ভাইয়ের শাসন । মাইনস দেবতা পোসেইডনকে অনুরোধ করেন সাইন অফ সাপোর্ট হিসেবে তাঁকে যেন একটা সাদা ষাঁড় পাঠানো হয় । কথামত একটা ষাঁড় পাঠানো হল কিন্তু এর সৌন্দর্যতার কারণে মাইনস সেটিকে আর উৎসর্গ করলেন না । মনে মনে ভাবলেন পোসেইডন কিছু মনে করবেনা যদি তিনি এটার বদলে তাঁর পোষা ষাঁড়গুলো থেকে একটি উৎসর্গ করেন । তাই মাইনসকে শাস্তি দিতে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা আফ্রদ্যিতি সৃষ্টি করেন সুন্দরী পেসিফিকে । মাইনসের স্ত্রী পেসিফি হোয়াইট বুলের সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে যান । হিংস্র মাইনোটর ছিলো পেসিফির সন্তান ! পেসিফি মাতৃস্নেহ দিয়ে তাকে বড় করে তুলেন । কিন্তু সে বড় হয়ে হিংস্র ও বন্য বনে যায় । সে ছিলো মানুষ এবং পশুর আনন্যাচারাল সংকর । পড়ে মাইনস ডেলফির দৈববাণী অনুযায়ী একটা বিশাল লেবিরিন্থ তৈরি করান । পরে অবশ্য থেসিউস স্বেচ্ছাসেবক হয়ে মাইনটোরকে হত্যা করে ।


Scylla and Charybdis
স্কাইলা আর চেরিবডিস একত্রে সমুদ্র নিচে অতল গুহায় থাকতো । স্কাইলা ছিল ছয়মাথা বিশিষ্ট রক শোলের মত কুৎসিত একটা মনস্টার । সাগরের ঝড় ঝঞ্ঝা এবং নানা প্রতিকূলতার জন্য দায়ী করা হয় স্কাইলা ও চেরিবডিসকে । তারা খুবই ক্লোজ থাকতো । ফলে স্কাইলাকে ফাঁকি দিতে পারলেও চেরিবডিসকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয়না । একপক্ষকে ফাঁকি দেয়া মানে ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত আগুনে ঝাঁপ দেয়া । চেরিবডিস সাগরে একটা ম্যাগনেটিক ফোর্স সৃষ্টি করে, যা সবকিছু টেনে নিয়ে যেতে থাকে অভিমুখের দিকে । ক্র্যাকেন কে ওদের জ্ঞাতিভাই বলা হয় ।

Read More »

Sunday, June 25, 2017

গ্রীক মিথের ভিলেনগণ (পর্ব - ০২)

গ্রীক মিথের কাহিনীগুলো আমাদের সবারই কমবেশি জানা আছে । এবার পরিচিত হয়ে নিন ভয়ংকর কিছু দানবদের সাথে । এদেরকে মূলত দেবতারা তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ব্যবহার করতেন । কাজ শেষ আবার ধ্বংসও করে ফেলতেন । প্রাচীন গ্রীকের কয়েকটি কমন চরিত্র তুলে আনার চেষ্টা।


Cyclopes
বিশাল মাথা, কপালে একটামাত্র চোখ । এ হলো গিয়ে সাইক্লোপস । সাইক্লোপসকে বলা হয় ‘ঠান্ডারবোল্টস অব জিউস’ । সাইক্লোপস আসলে একটি ব্যাক্তিসতন্ত্রের নাম নয়, বরং দানবদের প্রিমরডিয়াল রেইসের একটা গ্রুপের নাম । প্রত্যেকেরই একটা করে চোখ, সাইক্লোপস এর মানে হচ্ছে বৃত্তাকার চোখ । বিভিন্ন গ্রীক সাহিত্যিকেরা একে বিভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করেন ।
হেসিওড বলেন, নিষ্ঠুর পলিফেমাস, সাইক্লোপস আর পসেইডনের পুত্র একটি দ্বীপে একসাথে বসবাস করত । সেখানেই জিউসের আদেশে ওডেসাস ওকে অন্ধ করে দেয় ।
হোমারের মতে, দেবতা জিউস টারটারাসের ডার্ক পিট থেকে তিনটা সাইক্লোপসকে মুক্ত করেন । আরানুস এবং তার পুত্র আর গইয়া । তারা একাধারে জিউসের জন্য বজ্রপাত সৃষ্টি করত, হেডিসের অদৃষ্ট হেলমেট আর পোসেইডনের ত্রিশূল হিসেবে ব্যবহৃত হত ।
রোমান এপিক কবি ভার্জিল তার দ্যা থ্রি অফ দি এ্যনেইড বইতে লিখেন, কিভাবে এনিয়াস এবং তার ক্রুরা ট্রয়ের ট্রোজান যুদ্ধের শেষে পালিয়ে এসে সাইক্লোপসদের দ্বীপে গিয়ে আশ্রয় নেয় ।
অনেকে আবার মনে করে সাইক্লোপস মিথটি মূলত দাঁড়া করানো হয়েছে একটি বহু আগের একটি ঘটনার দ্বারা । ১৯১৪ সালে Paleontologist ওথেনিয় আবেল অনুসন্ধান করতে করতে একটি মানুষের মাথার দিগুণ সাইজের স্কাল খুঁজে পান । পরে দেখা যায় স্কালটি একটি ডয়ার্ফ এলিফেন্টের ।


Gorgons
গর্গনস গ্রীক মিথলজির সবচেয়ে ভয়ংকর, কুৎসিত দানব, পৃথিবীর শেষপ্রান্তে বসবাস করতো । গ্রীকশব্দ Gorgos থেকে Gorgons এর উৎপত্তি যার অর্থ দাঁড়ায় Dreadful । গ্রীক লিটারেচার বলে এই টার্ম ওদের তিন বোনের যে কাউকেই নির্দেশ করে । তিনজনেরই আছে জীবন্ত সর্পকেশ- যেগুলো আবার পৃথিবীর যেকোনো বিষধরকে হার মানিয়ে দিতে পারে, এবং ভয়ংকর ভিসেজ আর সম্মোহনবিদ্যা যা যে কাউকেই মুহূর্তের মাঝে নিরেট পাথরে পরিণত করে দিতে পারে । তিনবোনের মাঝে মেডিউসা ছাড়া স্থেনো আর ইউরায়েলি ছিলো ইমমর্টাল । পরবর্তীতে জিউসপুত্র পারসিউস মেডিউসাকে কৌশলে পরাস্ত করে ।
গর্গনসদের বিচ্ছুরিত চোখের ফ্ল্যাশকে বলা হয় ‘দ্যা ডিভাইন আইস’ । এ চোখকে তুলনা করা হয় দেবী এথেনার পবিত্র পেঁচার চোখের সাথে । ক্লাসিক্যাল মিথ বলে গর্গনসরা ছিল বিশেষ শক্তির অধিকারী । তাদের কুৎসিত জিহ্বা শিকারের উত্তেজনায় স্টিকিং করলেই ওয়ার্স বেরিয়ে আসে, তাদের চক্ষুকে বলা হয় ইভিল আই । হিন্দু মিথলজির দেবী কালীর সাথে এদের আবার মিল পাওয়া যায়; স্টিকিং টাং, মাথায় সাপ প্যাঁচানো ইত্যাদি ।

Read More »

Thursday, June 15, 2017

গ্রীক মিথের ভিলেনগণ (পর্ব - ০১)

গ্রীক মিথের কাহিনীগুলো আমাদের সবারই কমবেশি জানা আছে । এবার পরিচিত হয়ে নিন ভয়ংকর কিছু দানবদের সাথে । এদেরকে মূলত দেবতারা তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ব্যবহার করতেন । কাজ শেষ আবার ধ্বংসও করে ফেলতেন । প্রাচীন গ্রীকের কয়েকটি কমন চরিত্র তুলে আনার চেষ্টা।


Argus
আর্গুস হচ্ছে গ্রীক মিথের একটা ভয়ংকর দানবের নাম । যার সারা শরীর জুড়ে মিট মিট করে একশত চোখ, সারা শরীরে একশো চোখ নিয়ে দেবী হেরার গার্ড হিসেবে ভূমিকা পালন করে আর্গুস । এরেস্টরের পুত্র আর্গুস এর পদবী হচ্ছে ‘গার্ডিয়ান অফ দি হেইফার নিম্প লো । বলা হয়ে থাকে আর্গুসের চোখে কোনদিন ঘুম তো দূরের কথা তন্দ্রাও আসে না, একটা মাছিও ওর চোখকে ফাঁকি দেবার উপায় নেই । হেরা তাকে জব দেয় একিডনা নামক একটা মনস্টার, সর্পমানবী যে কিনা অর্ধেক সাপ অর্ধেক মানুষ তাকে হত্যা করার । কিন্তু আর্গুস হচ্ছে জিউস কতৃক নিয়োজিত হোয়াইট হেইফারের গার্ড, যেখানে ওর কাজ হচ্ছে দৃষ্টি রাখা যেন লো পালাতে না পারে । আর্গুস একিডনাকে হত্যা না করে বন্দী করে রাখে নেমিয়ার জলপাই গাছের নিচে । এদিকে হেরা আগে থেকেই জানতো হেফার রাজ্য থেকে নিম্প লো পালানোর পরিকল্পনা করছিলো । জিউসও এদিকে আর পেরে উঠতে না পেরে অবশেষে মনস্থির করে লো কে মুক্ত করে দেবার । তাই হেরমেস নামক এক ঘাতক কে নির্দেশ দেওয়া হয় আর্গুস কে হত্যা করে ফেলার জন্য । হেরমেস পাথর দ্বারা একটা একটা করে আর্গুসের সবকটা চোখ খুলে নেয় । পরে দেবী হেরা তার প্রিয় ময়ূরপঙ্খীর লেজ আর্গুসের চোখ দ্বারা সুসজ্জিত করেন ।


Cerberus
কারবেরাস হচ্ছে একটা বিরাট দানব আকৃতির তিন মাথার কুকুর । সম্ভবত হ্যারি পটারের প্রথম বইটিতে এর উল্লেখ আছে । টাইফূন আর একিডনার স্পিরিট বলা হয় কারবেরাসকে । টাইফূনও একটা ভয়ংকর ফায়ার ব্রীথিং মনস্টার যার শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে নীল আগুন উঠানামা করে । এমনকি দেবতারাও তাকে সহজে চটাতে চাইতেন না ।
দেবতা অরথ্রাস খুবই ভয় পেতেন কারবেরাসকে, তাঁর মতে ইটস আ টু হেডেড হেলহাউন্ড । কারবেরাসের অতিরিক্ত দু মাথাকে মনে করা হত নরকের অগ্নিভূক । কারবেরাসের তিন মাথার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তিন মাথাই একসাথে সবকিছু রেসপন্ড করবে এবং তিন মাথা ক্রমান্বয়ে রিপ্রেজেন্ট করে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ একই সাথে আরেকটি সোর্স এই তিন মাথার জাজ অনুযায়ী রিপ্রেজেন্ট করে জন্ম, নবযৌবন এবং যৌবনহীনা মানে বৃদ্ধ আর কি । প্রত্যেকটি মাথার ক্ষুদা মিটে জীবিত মাংস আর উষ্ণ রক্ত দ্বারা এবং অসহায় ভিক্টিমের আত্না মুক্ত হয়ে প্রবেশ করে এমন এক আন্ডারওয়ার্ল্ডে যেখান থেকে কেউই মুক্তি পায়না । সেখানে কারো আত্না নবযৌবন পাবে, কেউবা মাত্র জন্মাবে আর হতভাগা কেউ বৃদ্ধ হয়েই কাটাবে আজীবন । এই আন্ডারওয়ার্ল্ডের কারারক্ষীও কারবেরাস । শিকার যাতে কিছুতেই বের হতে না পারে সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখে । এই ভয়ংকর দানব কারবেরাস শেষ পর্যন্ত কার হাতে পতিত হয় জানেন? জিউসপুত্র হাফগড হারকিউলিস !! হারকিউলিস স্পেশাল ওয়েপন দিয়ে কারবেরাসকে ধ্বংস করে ।
Read More »

Tuesday, April 25, 2017

গোয়েন্দাগিরি

বিরক্তির সাথে চিরকুটটার দিকে তাকিয়ে থাকে তাহমিদ ।
‘কখনও কি ভেবেছ বন্ধুর চেয়ে একটুখানি_’
ব্যাস ! শেষ ।
আর কিছু নেই লেখা ।
বন্ধুর চেয়ে একটুখানি কি ? বেশি নাকি কম ?
ভ্রু কুঁচকে ও দু’সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে আরও ।
তারপর পাশে বসা জুয়েলের পেটে কনুই দিয়ে খোঁচা দেয় ।
‘গুতাস ক্যারে ?’ মোটাসোটা শরীরটা আরেকটু দুলিয়ে ফোঁস ফোঁস করে ওঠে জুয়েল ।
‘আরে কান্ডটা দ্যাখ !’ ওর হাতে গুঁজে দেয় কাগজের টুকরোটা ।
‘কোথায় পাইলি ?’
‘ব্যাগের মধ্যে ঢুকানো ছিল । কলম রাখি যে পকেটে ।’
‘কে পাঠাইছে লেখা নাই তো ।’
‘আরে তুই বের করতে পারবি না ?’
‘খাড়া খাড়া জিনিসটা বুইঝা লই ।’ মোটা শরীরটা একটু ঘুরিয়ে ব্যাগ থেকে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে জুয়েল ।
বেশ কিছুক্ষণ কুঁতকুঁতে চোখ মেলে তাকিয়ে মিনিট পাঁচেক দেখে মাথা নাড়ে । আগ্রহের সাথে এই পর্যবেক্ষণ দেখছিল তাহমিদ । আর ধৈর্য রাখতে পারে না ও ।
‘কিছু পেলি ?’
‘হুম !’ মাথা তুলে জুয়েল । ‘কিন্তু আগে বলুম না । তুইও দেখ । তারপর একলগে ।’
তাহমিদও ম্যাগনিফাইং গ্লাস চোখে আটকে দেখতে যাবে – এই সময় ক্লাসে ঢুকে পড়লেন দেবনাথ স্যার । ইনি ইংরেজী পড়ান । সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান দেখিয়ে আবার বসে পড়ে ।
কলেজে আধ-ঘন্টার লাঞ্চ ব্রেকের পর এই প্রথম ক্লাস ।
লাঞ্চ ব্রেকের আধ-ঘন্টার মাঝেই কেউ চালিয়ে দিয়েছে এই চিরকুট ।
দেবনাথ স্যার এখন অ্যাটেনডেন্স নেবেন ।
নিজের রোলটা পার হয় যেতেই আবারও ঝুঁকে পড়ে তাহমিদ কাগজটার ওপর । হাতে আতশী কাচ ।
পাশের সারি থেকে ওদের ভাব ভঙ্গী দেখে মুচকি হাসে প্রিয়াংকা আর কেয়া ।
‘উমম...’ মাথা তোলে এবার তাহমিদ । ‘যদিও তুই-ই ক্লাসের একমাত্র গোয়েন্দা । তবুও আমিও চেষ্টা করে দেখি ... ম্যাটাডোর কলমে লেখা, উমম ... কাগজটা কাটা হয়েছে হাতে ছিড়ে ...উহু,থুতুতে ভিজিয়ে, আর্দ্র কাগজের কোণা শক্ত হওয়ার লক্ষণ থেকে যায়...আর এইটা ডাক্তারী প্যাড থেকে ছেঁড়া একটা কাগজ । অ্যাম আই রাইট ?’
‘সাবাশ !’ গোবদা হাত দিয়ে ওর পিঠ চাপড়ে দেয় জুয়েল । ‘প্রায় সবকিছুই ধইরা ফেললি ! আরেকটা জিনিস বাকি – লেখাটা একটা মাইয়ার । সম্ভবতঃ – হাতের লেখা পাল্টাইছে যে লেখছে । মানে তোর পরিচিত ওই মাইয়া । আর না পাল্টাইলে অন্য কাওরে দিয়ে লেখাইছে ।’
জুয়েল কলেজে গোয়েন্দা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত ।
একমাস আগে চুরি হয়ে যাওয়া মকসুদের মোবাইলটা বের করতে জুয়েলের লাগে সাড়ে তেতাল্লিশ ঘন্টা । আর আড়াই দিন আগে বোর্ডে লেখা অশ্লীল বাক্যের রচয়িতাকে ওর বের করতে লেগেছিল আড়াই মিনিট ।
কিন্তু বেচারার ওজন একশ দশ কেজি । প্রথম কয়েক সপ্তাহ ওর নিকনেইম ‘ভোটকা’ হয়ে গেলেও কেসগুলো সমাধানের পর থেকে সবাই ওকে সমীহের চোখে দেখে । এই পর্যন্ত কলেজের সাতটি রহস্যের সমাধান করে ও । সমাধানের হার শতভাগ ।
সেই জুয়েলের পাশে বসে তাহমিদের ব্যাগে অপরিচিত নোট লেখে যাবে কোন একজন – জুয়েলের ভাষায় – ‘মাইয়া’ – আর কালপ্রিটকে ধরতে পারবে না ওরা – এ তো সাংঘাতিক লজ্জার কথা ।
কিন্তু এই দফায় চ্যলেঞ্জ করতে বাধ্য হয় তাহমিদ ।
‘কোন মেয়ের লেখা – আর তাও সেটা পালটে ?? এগুলো কিভাবে বললি ?’
‘খেয়াল করলে তুইও পারতি ।’ মামুলি কাজ করে ফেলেছে – এরকম ভাবে নাক-মুখ কোঁচকায় জুয়েল । ‘হাতের লেখার ধাঁচ ওরকম মাইয়াগোরই হয় । লেখা নিয়ে সৌখিনতা পোলারা করে না এত । ওগো লেখা জঘন্য হলেও দেখবি একটা সাজানো গোছানো ধরণ আছে । ওইটা দিয়া বোঝা যাইতেছে লেখছে একটা মাইয়া । আর অপরিণত ভাবটা খেয়াল কর – হয় ছোট বাচ্চায় লেখছে – অথবা মাইয়া নিজেই নিজের লেখা পাল্টানোর চেষ্টা করছে । শিওর !’
এবারে কিন্তু তাহমিদই অভিভূত হয়ে যায় ।
‘সাবাশ দোস্ত !’ জুয়েলের পিঠে চাপড়ে দিয়ে বলে ও । ‘বেশ উন্নতি হয়েছে রে তোর -’
‘চমৎকার !!’ দেবনাথ স্যারের গলায় প্রশংসার চাইতে ব্যাঙ্গই বেশি প্রকাশ পেল । ‘ক্লাস শুরু হতেই পিঠ চুলকে দিচ্ছ একে অন্যের ! কি মোহাব্বত ! দাঁড়িয়ে থাক তোমরা দুইজন ।’
‘ওহ শিট !’ বিড় বিড় করে তাহমিদ ।
হেসে কুটি কুটি হয় প্রিয়াংকা আর কেয়া ।

কলেজ থেকে বের হয়ে জুয়েলের হাতে কাগজটা তুলে দেয় তাহমিদ ।
‘দোস্ত এভিডেন্সটা তুই বাসায় রাখ । পরে কাজে লাগতে পারে ।’
‘আমার কিন্তু এরই মধ্যে একজনরে সন্দেহ হয় দোস্ত ।’
‘আরে আরও তথ্য প্রমাণ দরকার ।’ গেটের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় তাহমিদ । ‘ওই যে প্রিয়াংকা চলে এসেছে । যা তুই । কাল দেখা হবে ।’
হতাশায় মাথা নাড়ায় জুয়েল ।
জুয়েলের বাসা একদিকে আর তাহমিদের আরেকদিকে । ওদের পাশের বাসায় থাকে প্রিয়াংকা ।
কলেজে যাওয়া আসাটা তাই একসাথেই হয় ।
বাসে উঠে পাশাপাশি বসে ওরা ।
এতক্ষণে সুযোগ পেয়ে খোঁচাতে ছাড়ে না প্রিয়াংকা ।
‘ক্লাসে দেখলাম কি একটা কাগজ নিয়ে শার্লক হোমসগিরি ফলাচ্ছিস তোরা ।’
‘কই না তো !’ আপত্তি করার চেষ্টা করে তাহমিদ ।
‘কি ছিল রে ? কেউ প্রেমপত্র দিয়েছে নাকি ? বেনামী ?’ মজা পায় প্রিয়াংকা ওকে বিব্রত হতে দেখে ।
‘এক রকম । লাঞ্চ-টাইমে কেউ আমার ব্যাগে ভরে দিয়েছিল ।’ স্বীকার করতে বাধ্য হয় তাহমিদ । তারপরই লাফ দিয়ে সোজা হয়ে বসে । ‘তুই জানলি কি করে ? তোর কাজ এইটা ??’
চোখ থেকে হাসি হাসি ভাবটা চলে যায় প্রিয়াংকার । ‘জানব কি করে ? গেস করেছি । যেভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলি । তাছাড়া লাঞ্চ-টাইমের বেল বাজতেই ক্লাস থেকে কেয়ার সাথে বেরিয়ে যাই আমি ।’ কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে, ‘তাইলে তো তোর এবার হয়েই যাবে ।’
‘মানে কি !! কি হবে আমার ?’ সপ্তম আসমান থেকে পড়ে যেন তাহমিদ ।
‘দিলে তো ক্লাসের কোন মেয়েই দিয়েছে তাই না ? প্রেম হবে তোর ।’
‘শোন !’ জোর গলায় বলে তাহমিদ, ‘যেই মেয়ের সামনে এসে বলার সাহস নাই – এরকম মুরগির কলিজাওয়ালা মেয়ের সাথে আমি প্রেম-ট্রেম করতে পারব না । আমার প্রেমিকা হবে অনেক সাহসী । হুহ !’
‘এহহ!’ তীক্ষ্ণ গলায় প্রতিবাদ জানায় প্রিয়াংকা । ‘যেই না উনার সাহস । আর চায় সাহসী প্রেমিকা !’
প্রিয়াংকাকে কিল দেয় তাহমিদ ।
‘আবার মারেও অবলা একটা মেয়েকে ।’ অভিমানী গলায় বলে ও ।
আরেকটা কিল দেয় তাহমিদ ।
বাস ছুটে চলে ।


পরদিন লাঞ্চ-টাইম থেকে ফিরে এসে ব্যাগ খুলে এবার রীতিমত আর্তচিৎকার করে ওঠে তাহমিদ ।
‘ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছিস কেন ?’ বিরক্ত হয় জুয়েল ।
‘আমি মোটেও চেঁচাচ্ছি না !’ ষাঁড়ের মতই চেঁচিয়ে বলে এবার তাহমিদ । ‘এইটা দ্যাখ !’
বেশ বড় একটা খাম । তার মাঝে একটা মাত্র পাতার চিঠি ।
সেটা বড় কথা না ।
চিঠিটা রক্তে লেখা ।
‘তাহমিদ ,
এতদিন ধরে পাশে রেখেছ । বন্ধু ছাড়া আর কিছুই ভাবো নি কোনদিন । জানি আরও একটা বছর পাশে পাব তোমায় । কিন্তু আমি যে তোমায় বন্ধু ভাবতে পারি না আর । ভালোবাসি তোমায় এতটা । মুখে বলে বন্ধুত্বটা নষ্ট করে ফেলতে চাই না । তবুও তোমাকে না জানিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না । বন্ধুর থেকে বেশি না ভাব – আমি ভালোবেসে যাব তোমায় – আজীবন ।’
‘আমি তো মাননীয় স্পীকার হইয়া গ্যালাম !’ নিজ ভাষায় বিড় বিড় করে জুয়েল । মোটাসোটা শরীরটা একেবারে পাথর হয়ে গেছে ঘটনার আকস্মিকতায় ।
‘নাম নেই ।’ চোখ তোলে তাহমিদ। ‘কে হতে পারে ।! কে ?? জানাটা দরকার । এত পাগলামী কেন করবে ?’ একসেকেন্ড ভেবে ডাক দেয়, ‘মাননীয় স্পীকার !!’
‘হ !’ তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেয় জুয়েল ।
‘এই চিঠিকে এভিডেন্স ধরে কি পাচ্ছিস ? আমাকে জানা । ’
চিঠি ধরে উলটে পালটে দেখে জুয়েল । তারপর নিরাশ হয়ে মাথা নাড়ে ।
‘ডিএনএ টেস্ট করা লাগব !’
‘বসে আছিস কেন ? করে আন !’ তাড়া দেয় তাহমিদ ।
‘আমারে কি তোর সিআইডির লোক মনে হয় দেইখা ?’ ঝাড়ি মারে ওকে জুয়েল । হঠাৎ আগ্রহের সাথে খামটা তুলে নেয় । ‘তয় – এই খাম আমগোরে লীড দিবার পারে ।’
‘খামে কোন ঠিকানা ছিল না, মি. স্পীকার ।’
‘ওই আমারে স্পীকার কইবি না । হইয়া গেছিলাম । এখন নাই আর ।’ বলে জুয়েল গোবদা হাত দিয়ে পিঠে একটা চাপড়ও দেয় তাহমিদকে ।
আবার বলে তারপর, ‘ঠিকানা নাই – কথা সত্য । কিন্তু খামে গন্ধ থাইকা যায় । শুইকা দেখ !’ তাহমিদের দিকে আগ্রহের সাথে খামটা বাড়িয়ে দেয় ও ।
‘আমি বাবা রক্তের গন্ধ-টন্ধ শুঁকতে পারব না ।’ নাক মুখ কোঁচকায় তাহমিদ । ‘তোর মন চাইলে তুই নাক ডুবিলে বসে থাক !’
অক্ষরে অক্ষরে তাহমিদের নির্দেশ পালন করে জুয়েল । নাকটা ডুবিয়ে চুপচাপ বসে থাকে মিনিট তিনেক ।
তারপর মুখ তোলে ।
‘একটা বডি পারফিউমের গন্ধ পাইছি । তুই শুইকা দেখ ।’
‘মরলেও না !’ তারস্বরে প্রতিবাদ জানায় তাহমিদ ।
হাতির পায়ের মত হাত দিয়ে ওকে চাপড়িয়ে উৎসাহ দেয় জুয়েল । শিড়দাঁড়া ভেঙ্গে যাওয়ার আগেই খামের গন্ধ শোঁকা উত্তম – হাত বাড়ায় তাহমিদ ।
একমিনিট পর মাথা তোলে ।
‘গন্ধটা আমার পরিচিত । দোস্ত – কালকে তুই কাকে যেন সন্দেহের কথা বলছিলি ?’
‘কইতাম কিন্তু রাগ করতে পারবিনা কইলাম !’ গ্যারান্টী চায় জুয়েল ।
‘না করব না । বল ?’
‘আমার তো প্রিয়াংকারে ধুমাইয়া সন্দেহ হইতেছে ।’
‘আরে নাহ ।’ আপত্তি জানায় তাহমিদ নিজেই । ‘কাল ওকে চার্জ করেছিলাম । কিন্তু ও সবার আগেই লাঞ্চ করতে বের হয়ে যায় । আজও আমার সন্দেহ যায় নি – তাই খেয়াল করেছি – সবার আগে ও আর কেয়া বেড়িয়ে যায় ক্লাস রুম থেকে ।’
‘আরে বলদা রে !’ তাহমিদের বুদ্ধির প্রশংসা করে জুয়েল । ‘এরা বাইর হইয়া বাইরে ছিল কোথাও আশে পাশেই – আমরা বাইর হতেই আবারও লাফায়া ঢুকছে ! ’
‘হুম ...’ টোকা দেয় তাহমিদ টেবিলে, ‘লাফিয়ে না ঢুকলেও – আমরা যাওয়ার পরে ঢুকতেই পারে ...’
হঠাৎ জুয়েলের পাহাড়ের মত শরীরটা শক্ত হয়ে যায় । ফিসফিস করে বলে,
‘তাহমিদ, দ্যাখ !! প্রিয়াংকার ডান হাতের দিকে তাকা !’
তাকিয়ে চমকে যায় তাহমিদ ।
প্রিয়াংকার ডান হাতের তর্জনী পেঁচিয়ে আছে ব্যান্ডেজে ।
হাত কেটে গেছে ?
নাকি নিজে থেকে কেটে চিঠিটা লেখেছে ও ?

‘আজ পারলে প্রিয়াংকারে একটু গুঁতায়া বাইর করার চেষ্টা কর দোস্ত ।’ সাজেশান দেয় জুয়েল ওকে । ‘মুখে কইব না যখন তখন গুতাইন্নাই লাগব । হুদাই কষ্ট পাইব ক্যান ?’
‘হুঁ ।’ সায় দেয় তাহমিদ ।
‘রক্তের চিঠিটাও কি আমি নিয়া যামু ? এভিডেন্স তো ।’
‘না । ওটা আমার কাছেই থাকুক ।’
‘মাইয়াটারে আবার বাসে বেশি জেরা করিস না । যদি আমাদের সন্দেহ ভুল হয় তাইলে কিন্তু ইজ্জত মার্ডার ।’
‘আচ্ছা ।’ তাহমিদের গলার স্বর আজ পরিবর্তিত।
দেখে সন্তুষ্ট হয় জুয়েল । ছেলে প্রিয়াংকাকে জেরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ।
কেসটা আনসলভড থেকে যাবে এই ভয়টা ছিল ওর ।
বাসে উঠে ওই ব্যাপারে প্রিয়াংকাকে খোঁচানোর কোন সুযোগই পেল না আজ তাহমিদ ।
‘অ্যাই তোর হাত কিভাবে কেটেছে ?’ সরাসরি প্রশ্ন করে ওকে ।
‘কাল রাতে মাছ কাটতে গিয়ে । কাটাকাটি পারি না তো !’ হাই চেপে বলে মেয়েটা ।
 ‘ওহ ।’ কি বলবে ভেবে পায় না তাহমিদ ।
‘কাল সারা রাত ঘুমাইনি রে ।’ চোখ বোজে ও । ‘আমি চোখ বন্ধ করে থাকি একটু ।’
প্রিয়াংকার চোখ খোলার অপেক্ষায় থাকে তাহমিদ ।
কিন্তু কিসের কি ! বলতে বলতেই পাঁচ মিনিটের মাঝেই ঘুম !
‘স্বাভাবিক । সারা রাত কেটেছ হাত ।’ মনে মনে বলে তাহমিদ । ‘গতকাল আমার সাহসী প্রেমিকা লাগবে বলাই উচিত হয় নাই । ’
মনটা খারাপ হয়ে যায় ওর ।
বাস তখন দাঁড়িয়ে জ্যামে । দশ মিনিটের দূরত্ব পার হতে এভাবেই লাগায় আধঘন্টা ।
আলতো করে প্রিয়াংকার ঘুমন্ত মাথাটা ঢলে পড়ে তাহমিদের কাঁধে ।
সরাতে গিয়েও সরায় না ও ।
খামের মধ্যে পাওয়া সুগন্ধটা তীব্রভাবে নাকে আসে ওর ।
ঘুমন্ত মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আজ বড় মায়া হয় তাহমিদের ।
মুখ ঢেকে দেওয়া এক গুচ্ছ চুল সরিয়ে দেয় ও পরম মমতার সাথে ।


পরদিন সকাল ।
লাইব্রেরীর এক নির্জন কোণা বেছে নিয়েছে প্রিয়াংকা আর তাহমিদ ।
আজ যা কথা বলার বলে ফেলতে চায় তাহমিদ ওকে ।
জুয়েলটাকেও আসতে বলেছে । কিন্তু হোৎকাটা দেরী করছে ।
অস্বাভাবিক কিছু না অবশ্য ।
“যতই স্থুল হবে তুমি - গতিবেগ ততই কমবে তোমার” – নীতিতে বিশ্বাসী তাহমিদ ; জুয়েলের দেরীকে গ্রাহ্য না করে তাই আসল কথায় চলে আসে ।
‘প্রিয়াংকা – তোর সাথে কিছু কথা ছিল ।’
‘আমারও ।’ কেমন যেন নিস্তেজ গলায় বলে প্রিয়াংকা আজ ।
নিশ্চিত হওয়ার এই সুযোগ ছাড়ে না তাহমিদ । সন্দেহ ভুল হলে ; অর্থাৎ প্রিয়াংকা ওই চিঠিগুলো না পাঠালে বেশ লজ্জার একটা ব্যাপার হয়ে যাবে । তাহমিদ যে মেয়েটার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে – নিজের কাছে আর লুকাতে পারে নি ও । গতকাল বাসেই অনুভূতিটা বুকে একেবারে লাফালাফি শুরু করেছিল । ভাগ্যিস – ঘুমাচ্ছিল প্রিয়াংকা । নাহলে কেলেংকারী হয়ে যেত !
‘বল তাহলে ।’ প্রিয়াংকাকে আগ বাড়িয়ে চাল দেবার আহবান জানায় তাহমিদ ।
‘তোর দিকে আজকাল অনেক মেয়ে নজর দেয় ।’ শ্রাবণের মেঘ জমে প্রিয়াংকার মুখে । ‘আমার এসব একেবারে সহ্য হয় না ।’
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তাহমিদ ।
‘তোকে ভালোবাসি আমি, তাহমিদ !’ মুক্তোর মত একফোঁটা পানি পড়ে প্রিয়াংকার গাল বেয়ে ।
‘অ্যাই বোকা মেয়ে ! কাঁদছিস কেন ?’ তাড়াতাড়ি ওর হাত ছোঁয় তাহমিদ । ‘তোকে এটা বলতেই আজ এখানে এনেছি । কখন জানি তোর প্রেমে পড়ে গেছি আমিও । দেখ তো কি রকম গাধা আমি !’
চোখে পানি নিয়েই হেসে ফেলে প্রিয়াংকা ।
এই সময় লাইব্রেরীতে ঢোকে জুয়েল ।
প্রিয়াংকার কান্না-হাসির সাথে ওদের হাতে হাত ধরে রাখা দেখেই যা বোঝার বুঝে ফেলে ও ।
বিশাল শরীরের তুলনায় অতি ক্ষুদ্র দাঁতগুলো ঝিলিক মারে ।
গোয়েন্দা জুয়েলের এতটা আনন্দিত চিত্র আগে কখনও দেখেনি কেউ ।
‘তুই একটা পাগলি, প্রিয়াংকা !’ এবার আলতো ধমক দেয় ওকে তাহমিদ । ‘আমাকে সরাসরি বলতেই পারতি । নোট রেখে গেছিস তাও মানা যায় । তাই বলে হাত কেটে সেই রক্ত দিয়ে চিঠি লেখাটা বাড়াবাড়ি করেছিস ! এরপর যদি আর ...’
প্রিয়াংকার মুখে নিখাদ বিস্ময় দেখে থেমে যায় তাহমিদ ।
‘তুই ভাবিস আমি ওই চিঠি রেখে তোকে মিথ্যা করে বলেছি ? আর কিসের রক্ত মাখা চিঠি ?’
‘তুই লেখিস নি বলতে চাস -’ এক সেকেন্ড ভাবে তাহমিদ । ‘তাই তো ! আমি আগে কেন বুঝি নি ?? ‘স্বস্তি’ লেখা ছিল চিঠিতে । ’ পকেট থেকে বের করে চিঠিটা ।
“তবুও তোমাকে না জানিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না” লাইনটা দেখায় প্রিয়াংকাকে ও।
‘কলম দিয়ে ‘স্বস্তি’ লেখাটা স্বস্তিদায়ক হতে পারে । কিন্তু কেউ হাত কেটে স্বস্তি লেখবে না । প্যাঁচ দেখেছ ? এরচেয়ে প্রতিশব্দ ব্যবহার করে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে । এইটা এই মোটকুর কাজ । নির্ঘাত !! ’
একটা কলম বন্দুকের মত তাক করে ও জুয়েলের দিকে ।
‘আরে আরে চ্যাতস ক্যারে ?’ হাহাকার করে ওঠে জুয়েল । ‘দেখলাম তোগোর ভিতরে ভালোবাসা পাংখা মেলতেছে কিন্তু কইতেছস না একজন আরেকজনরে তাই ক্যাটালিস্ট দিছি জাস্ট ।’
‘দাঁড়া বলিস না ।’ হাত তুলে ওর দিকে তাহমিদ । ‘আমার পিছে বের হওয়ার সময় তুই ভেতরে খাম ঢুকাইছিস এইটা তো পানির মত সোজা । আর লেখাইছিস তোর ছোটবোনকে দিয়ে, প্রথম চিঠিটা । আর রক্ত ... উমম রক্তের ব্যাপারটা নিশ্চয় আংকেলের কাছে ব্লাডব্যাগ হাতাইছিস । আর কোন ব্যাখ্যা থাকতে পারে না । খামের মধ্যে বাসা থেকে পারফিউম মেরে এনেছিলি সেটা তো বোঝা সহজ । অ্যাম আই রাইট ?’
‘পুরাই ।’ মাথা নাড়ায় জুয়েল । ওর বাবা একজন বায়োলজিস্ট । ‘ব্লাড ব্যাংকের কিছু নষ্ট হওয়া স্যাম্পল নিয়া বাবা কাজ করতাছিল । ওইদিন গেলাম দ্যাখা করতে । দেখি একটা থাইকা গেছে কাজ শেষেও । নিয়া আইতে চাইলাম । দিয়া দিল । তখন থেকেই মাথায় ঘুরতাছে প্ল্যানটা ।’
‘ইয়াহ !’ আনন্দে মাথা ঝাঁকায় তাহমিদ । ‘এইটা আট নম্বর ।’
‘দাঁড়া দাঁড়া!’ ধরে ফেলে প্রিয়াংকা, ‘কলেজ কেসগুলো তুই সব সলভ করেছিলি, তাই না তাহমিদ ? তারপর জুয়েলকে দিয়ে বলাইছিলি ? হুম – ওকে যাতে সবাই সমীহ করতে বাধ্য হয় তাই –’ এক মুহূর্ত থেমে নতুন দৃষ্টিতে দেখে আজ প্রিয়াংকা তাহমিদকে । তবে ওই একমুহূর্তই ।
‘তুই একটা ইবলিশ রে !’ কিল দেয় প্রিয়াংকা তাহমিদকে এবার ।
‘তোর মাথা ।’ এড়িয়ে যাতে চায় তাহমিদ ।
আবার কিল দেয় ওকে প্রিয়াংকা ।
এই দুইটা এইভাবে আজীবন খুনসুটি করুক ।
একমুখ হাসি নিয়ে লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে আসে জুয়েল ।
বুকে একরাশ ভালোলাগার অনুভূতি ।

Read More »

Saturday, March 25, 2017

উত্তরাধিকার

কনুই থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া কাটা হাতটার দিকে কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে নীরব ।
প্রতিদিনই সবার আগে আগে ক্লাসে চলে আসে ও ।
ওর বাবা-মা নেই । কার অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন এক মাস হল ।
এর পর থেকে বাসাতে থাকতে ভালো লাগে না ওর মোটেও ।
এই একসপ্তাহ হল শোকের ধাক্কা কাটিয়ে উঠে ক্লাসেও আসা শুরু করেছে – এর মাঝেই ভুল ভাল দেখতে শুরু করল ?
ক্লাস রুমের মাঝে কাটা হাত পড়ে থাকার কোনই কারণ নেই ।
হাতটা আসল হাত নাকি ডামি দেখা দরকার ।
কাজেই মেঝে থেকে আলতো করে ধরে তুলে ও টেবিলের ওপর ওটাকে ।
এবং কাছ থেকে দেখতে পেয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় ।
হাতটা কোন একজন মেয়ের ।
তবে সেটা সমস্যা নয় । বাম হাত এটা ।
আর কানি আঙ্গুলে চুপচাপ বসে থাকা নীল রঙের পাথরের আংটিটা ওর খুব ভালো করেই চেনা ।
এটা রিনিতার হাত !
ওর অন্যতম প্রিয় বন্ধু রিনিতার হাত !
অবিশ্বাসের দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকে নীরব ।
ঠিক এই সময় ক্লাসে এসে ঢোকে সুমি ।
এক সেকেন্ড চোখে চোখে তাকিয়ে থাকে ওরা ।
পরমুহূর্তেই রিনিতার হাতটা চোখে পড়ে যায় সুমির ।
তীক্ষ্ণ চিৎকারে ক্লাসরুমটা ভরিয়ে দেয় রিনিতার বেস্ট ফ্রেন্ড সুমি ।

পুলিশ জেরা করছে নীরবকে প্রায় এক ঘন্টা ধরে ।
নীরবের মনে হয় কয়েক যুগ পার হয়ে যেতে শেষ হল ওদের জেরা ।
‘রিনিতার সাথে তোমার শেষ দেখা কবে ?’ ‘রিনিতা আর তোমার সম্পর্ক কেমন’ ‘তুমি এত আগে ক্লাসে কি করছিলে’ ‘তুমি কেন হাতটা পেয়ে পুলিশে না জানিয়ে নিজের কাছে রেখেছিলে ?’ ‘রিনিতার সাথে তোমার শেষ দেখা কবে ?’
ঘুরে ফিরে একই প্রশ্ন – শতবার । অবশেষে যেন ওদের মনে হল নীরবকে ছাড়া যায় ।
তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বের হয়ে আসে নীরব ।
রিনিতাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় নি ।
ছোট্ট একটা শহর ।
কোনকিছুই চাপা থাকে না ।
রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় নীরবের মনে হয় প্রত্যেকে ওর দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ।
‘ছেলেটার ব্যাগে একটা হাত ছিল । ওরই বান্ধবীর হাত ।’ – দুটো অল্পবয়েসী মেয়ে যেতে যেতে এই কথা বলে , স্পষ্ট শুনে নীরব ।
চমৎকার ! – মনে মনে না ভেবে পারে না নীরব ।
গল্পটার শাখা প্রশাখা বানিয়েছে ভালোই ।
ক্লান্ত পায়ে এসে নিজের বাসাটার দরজা খুলে ।
এই বাড়িটা মাত্র এক মাস আগেই ওর জন্য ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আশ্রয় ।
পাহাড়ী রাস্তা ধরে আসছিলেন ওঁরা সে রাতে ।
নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাবা-মা দুইজনকে নিয়ে গাড়িটি পড়ে যায় খাদ বেয়ে ।
খবরটা পায় নীরব মোবাইলে ।
প্রতিবেশীরা ওকে ওদের বাগানে পড়ে থাকতে দেখে ।
মাথায় আঘাত পেয়েছে ভালোই ।
সবাই বোঝে – বাবা-মার মৃত্যু সংবাদ সহ্য করতে না পেরে ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে ছেলেটা ।
তবে কয়েকদিন চিকিৎসাধীন থেকে আর সহ্য হয় না নীরবের ।
আবারও কলেজে যেতে শুরু করে ।
এর একসপ্তাহের মাঝেই ঘটে গেল এই দুর্ঘটনা ।
এই মুহূর্তে অবশ্য বাসার দরজা খুলে ওর মন কিছুটা ভালো হয়ে যায় ।
‘হোম – সুইট হোম ।’ বিড় বিড় করে বলে ।
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বাড়ির চেয়ে আরামদায়ক আর কি হতে পারে ?
বাবা-মার ঘরের দিকে চোখ পড়তেই দীর্ঘশ্বাস পড়ে ওর বুক থেকে ।
এবং একরাশ সন্দেহ দানা বাঁধে সেই সাথে ।
বাবা-মার মৃত্যু পর থেকেই এই কথাটা ভাবাচ্ছে ওকে ।
তৌফিক ওমর চাচাকে মনে করার চেষ্টা করে ও খুব করে ।
কিন্তু সেই ছোট্ট বেলায় একবার দেখা চাচার চেহারা ভালো করে মনে আসে না ওর কিছুতেই ।
ওমর চাচা ছিলেন বাবার সৎ ভাই ।
এক এবং অদ্বিতীয় জীবিত আত্মীয় ।
দুর্বিনীত, নিষ্ঠুর এবং বেপরোয়া মানুষ ছিলেন ওমর চাচা ।
এবং গত পনের বছর ধরে তিনি নিখোঁজ ।
ওমর চাচাকে নিয়ে অনেক কল্পকথাই ছড়ানো হয়েছে এর পরে ।
কেউ বলে তিনি ইউরোপে চলে গেছেন ।
কেউ বলে, না – তিনি আছেন জাপানে – সোর্ডফাইটে নাকি তিনি একজন গুরু ।
বক্তারা নিজ চোখে দেখে ওই সব দেশ থেকে ফোন দিয়েছিলেন ।
তবে ওমর চাচা দেন নি একটা ফোনকলও । বাবাকে ঘৃণা করতেন তিনি ।
তবে এখন নীরবের ঘোর সন্দেহ হয় ।
চাচা কি আসলেই বাইরে এখনও ?
নাকি সব সঞ্চয় উড়িয়ে দাদার বিশাল সম্পত্তি হাতানোর জন্যই বাবা-মাকে সরিয়ে দিয়েছেন দেশে ফিরে ?
এখন রিনিতার মৃত্যুর সাথেই বা কেন নীরবের সম্পর্ক পাওয়া যাচ্ছে ?
পেছনে কি ওমর চাচার হাত আছে ?
নীরবকে ফাঁসিয়ে শেষ বাঁধাটা দূর করে দিতে চান ওমর চাচা ?
ভাবনার ডালপালা বন্ধ করে ফ্রিজের দিকে আগায় নীরব ।
কোল্ড ড্রিংকস খাওয়া যেতে পারে একটা । যা দিন গেছে !
ডালা খুলেই স্থির হয়ে যায় ও ।
ভেতরে সুন্দর করে একটা প্লেটে বসানো হৃৎপিন্ডটা মানুষের – বুঝতে মোটেও সমস্যা হয় না ওর ।
কার – সেটাও বুঝে যায় নীরব ।
রিনিতার !
ঘন ঘন কলিং বেল পড়ে এই সময় বাসায় ।
পুলিশ ?


সাবধানে দরজা খুলে নীরব ।
সুমি ।
ফ্যাকাসে চেহারা আর ফর্সা গাল দুটোতে একটা ধারা দেখেই বুঝতে পারে ও – কাঁদছিল এতক্ষণ ।
‘ভেতরে আসতে পারি ?’
‘নিশ্চয় ।’ সম্বিত ফিরে পায় নীরব । পুলিশের ভয়ে মাথা নষ্ট হয়ে যাওয়ার যোগাড় হয়েছিল ওর ।
‘রিনিতার ব্যাপারে কিছু কথা ছিল ।’ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে সুমি ।
দরজা লাগাতে গিয়েও বাইরে তাকিয়ে থাকে নীরব ।
জংলামত জায়গাতে ক্রুর দৃষ্টিতে এদিকে তাকিয়ে আছে একজন মানুষ !
ওমর চাচা না ?
আবারও ভালো মত তাকায় নীরব ।
দেখা যায় না কাওকে ওখানে ?
‘কি দেখছ ?’ ওর পাশে এসে জানতে চায় সুমি ।
‘না – কিছু না ।’ দরজা লাগায় নীরব । ‘ভেতরে চলো ।’
সোফায় বসে দুইহাঁটু একসাথে লাগিয়ে একটু একটু কাঁপে মেয়েটা ।
‘রিনিতার ব্যাপারে কিছু একটা বলতে এসেছিলে ।’
‘ও -’ হঠাৎ যেন মনে পড়ে সুমির । ‘গোটা শহর তোমাকে সন্দেহ করে রিনিতার খুনী হিসেবে ।’
‘অথচ – আমি খুনটা করি নি !’ গলা চড়ে যায় নীরবের ।
আহত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায় সুমি ।
‘আমি জানি – খুনটা তুমি করনি । কারণ – আমিই শেষ ব্যক্তি – যে রিনিতাকে দেখেছিল ।’ দুই হাতে মুখ ঢাকে ও ।
‘আমাকে খুলে বল সব, সুমি ।’ ওর পাশে গিয়ে বসে নীরব । ‘নির্ভয়ে বলতে পারো ।’
‘সেদিন ও আমার বাসায় এসেছিল । গত শুক্রবারের আগের শুক্রবার । তোমাদের ফ্যামিলির দুর্ঘটনার তখন মাত্র দুই সপ্তাহ । প্রায়ই রিনিতা আসত আমার বাসায় এই সময়টায় । আরেকটা জায়গায় যেত ও । হাসপাতালে । তোমাকে দেখতে । ওরা বলেছিল ওই শুক্রবারে তোমাকে রিলিজ দেবে । রিনিতা আমার কাছে এসেছিল পরামর্শ করতে । ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল । ’
ইতস্তত করে সুমি । কাজেই প্রশ্ন করতেই হল নীরবকে, ‘কি বিষয়ে ?’
‘উম -’ চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেলে সুমি, ‘তোমাকে ও ভালোবাসত – সেটা বলবে কি না সে ব্যাপারে ।’
স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ সুমির দিকে তাকিয়ে থাকে নীরব ।
রিনিতাকে ওরও ভালো লাগত । কিন্তু এখন আর সে কথায় কাজ কি ?
খুনীর প্রতি প্রচন্ড একটা ক্রোধ অনুভব করে ও ।
‘কিন্তু ওই শুক্রবার আমি ছাড়া পাই নি । হঠাৎ ব্লাড প্রেশার ভয়ানক মাত্রায় কমে যাওয়ায় ডাক্তাররা বলেছিলেন আর দুই দিন থেকে যেতে ।’ হঠাৎ মনে পড়ে যায় নীরবের ।
‘আমি জানি তুমি খুনটা কর নি, নীরব ।’ চোখ মোছে সুমি । ‘কিন্তু খুনীকে আমি ধরবই । তুমি আছ আমার সাথে ?’
‘অবশ্যই !’ মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেয় নীরব, ‘রিনিতা আমারও খুব ভালো বন্ধু ছিল । তাছাড়া সব সন্দেহের তীর আমার দিকেই আসছে । আমার এই রহস্যের সমাধান করতেই হবে ।’
‘রিনিতার সাথে ঝগড়া ছিল একটা ছেলেরই । তবে ওই ছেলে ওকে মেরে ফেলবে একেবারে সেটাও বিশ্বাস করতে পারি না ।’ বলে সুমি ।
‘কার কথা বলছ ?’ ভ্রু কুঁচকায় নীরব ।
‘রিফাত ।’ দুই হাত একসাথে লাগিয়ে বলে সুমি, ‘রিফাত আর ওর দলবল রিনিতাকে খুবই উত্যক্ত করত মনে আছে ?’
‘হুঁ । মাত্র একমাসই তো যাই না ক্লাসে । মনে আছে সবই । ’
‘না – আরেকটু ঘটনা আছে ।’ ওকে থামিয়ে দেয় সুমি । ‘তুমি তখন হাসপাতালে । ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় ব্যাথা নিয়ে পড়ে আছ । রিনিতার সাথে একদিন একটূ বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলে রিফাত ।’
‘তারপর ?’ উৎসুক হয়ে জানতে চায় নীরব ।
‘ওকে গোটা ক্লাসের সামনে থাপ্পড় দেয় রিনিতা ।’
‘এতটুকুর জন্যই খুন করে ফেলবে – রিফাতকে আমার এমন ম্যানিয়াক বলেও মনে হয় না ।’ মাথা নাড়ে নীরব । ‘তুমি ভেব না –পিছে যে আছে তাকে আমরা ধরবই ।’
হঠাৎ-ই উঠে দাঁড়ায় সুমি । ‘ফ্রিজে ঠান্ডা পানি আছে ?’
নীরব মাথা হাল্কা ঝাঁকাতেই সোজাসুজি ফ্রিজের দিকে হাঁটা দেয় ও । বাধা দেয়ার সময় পায় না নীরব ।
ড্রইং ডাইনিং একসাথে ওদের । মাঝে একটা পর্দা থাকে তবে এখন সেটা সরানো ।
ফ্রিজের ডালা সরিয়ে পানির বোতল নিতে গিয়েই থমকে যায় সুমি ।
বুঝে ফেলেছে ? – সরু চোখে তাকিয়ে থাকে নীরব ।
সুমিকে ভুল বুঝতে দেওয়া যাবে না । রহস্যটা উদঘাটন করতেই হবে ।
ফিরে এসে ওর দিকে কিভাবে জানি তাকায় ! সন্দেহ ?
‘ফ্রিজের ভেতর কেমন গোস্ত পচা গন্ধ ।’ কথার কথা এভাবে বলে সুমি ।
‘কি জানি !’ অস্বীকার করে নীরব ।
‘ইশ ! একয়দিন ধোয়া হয় নি, না ?’ এতক্ষণে সুমির চোখের দৃষ্টিটা চেনে নীরব । মমতা । ‘ধুবেই বা কি ? জীবনে এসব করেছ নাকি ? আমি এসে একদিন ধুয়ে দেব । ঠিক আছে ?’
হাসে নীরব ।
এই সময় মোবাইলটা বেজে ওঠে । সোফার কাছ থেকে আসছে রিংটোন ।
সুমির হাতব্যাগের ভেতর থেকে ।
কলটা রিসিভ করে ওপাশের কথা শুনেই হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে যায় সুমির । সারা শরীর থর থর করে কাঁপে ওর ।
‘কি হয়েছে ?’ ওকে ধরে ফেলে নীরব ।
‘রিফাতের লাশ পেয়েছে ওরা পার্কের কোণে । কেউ ওর মাথায় বাড়ি দিয়ে বের করে দিয়েছে ঘিলু !’

সুমি দ্রুত বাসায় চলে যায় ।
আংকেল আন্টি টেনশনে ছিলেন । ফোন করে ডেকে নিয়েছেন ওকে ।
ওদের ক্লাসেরই দুইজন খুন হয়ে গেল – কাজেই ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি ।
তবে সুমি ফোন রিসিভ করার পর থেকেই ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে নীরবের পিঠ বেয়ে ।
বাবার আলমারি থেকে পিস্তলটা বের করে এনেছে ।
ওমর চাচার প্রতি সন্দেহটা আরও বেড়ে যাচ্ছে ওর ।
ওকে ছায়ার মত ফলো করছে একজন মানুষ – এটা নিঃসন্দেহ । সুমির ঢোকার সময়ই ব্যাপারটা বোঝে ও ।
ওমর চাচা বলেই মনে হয় ওর । যদিও চাচার চেহারা এতদিন পরে ও বিস্মৃত ।
পার্কটা পুলিশ স্টেশন আর ওর বাসার মাঝে ।
আজ পার্কটাকে শর্টকাট হিসেবে বেছে নিয়েছিল নীরব ।
কেউ না কেউ ওকে পার্কে ঢুকতে এবং বের হতে তো দেখেছে অবশ্যই ।
অর্থাৎ এই কেসেও ফাঁসানো যায় নীরবকে – অনায়াসেই ।
*
তবে মাথা যতদূর সম্ভব ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করে নীরব ।
এতদিন পরে ওর চাচা কয়েকটা খুন করে ওদের বিশাল পারিবারিক সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে চাচ্ছে – এটা কেউই বিশ্বাস করবে না ।
আরেকটা প্রশ্ন ওর মাথায় ধাক্কা দেয় ।
ওমর চাচা ওর বাসার ভেতর ঢুকল কি করে ?
রিনিতা কিভাবে মারা গেছে বুঝতে পারছে নীরব ।
নীরবের শুক্রবারে বের হওয়ার কথা ছিল হাসপাতাল থেকে ।
বাসার ওপর চোখ রেখেছিল ওমর চাচা ।
রিনিতাকে এদিকে আসতে দেখে ভেতরে ঢুকে যায় খুনী ।
কলিং বেল বাজাতেই নিজের পরিচয় দিতে রিনিতাও সন্দেহের কারণ না দেখে ভেতরে ঢুকে ।
বাবা-মা মৃত । নীরব হাসপাতালে ।
কাজেই একজন আত্মীয় থাকতেই পারে ওর সাথে ।
তখনই রিনিতাকে একা বাগে পেয়ে খুন করে ওমর চাচা । তারপর ছিন্নভিন্ন লাশটা থেকে হৃৎপিন্ডটা বের করে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখে নিশ্চয় ?
আর হাতটা – হাতটা হয়ত আগে ভাগেই এসে ক্লাসরুমে এনে রেখেছিল চাচা । সাত দিন পর ।
সাতদিন ঠান্ডায় সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে নিশ্চয় রিনিতার শরীর ।
আর এই সাতদিন ওকে ফলো করে নীরবের আগে আগে ক্লাসে যাওয়ার অভ্যাস সম্পর্কে ভালো মতই জেনে গেছিল চাচা ।
হতাশা চেপে ধরে নীরবকে ।
চাচার চক্রান্তে আজ ওকে দুটো খুনের জন্য সন্দেহ করা হচ্ছে – যার মাঝে একজন ওর খুব প্রিয় একটা মানুষ ।
অথচ প্রমাণ করার জন্য কিছু বের করতে পারছে না নীরব ।
পুলিশ ভাগ্যিস এখনও ভালো মত খেয়াল করেনি ব্যাপারটা । তাহলে কাজ হয়ে যেত ।
ভাগ্যিস সুমির কলিং বেলের সাথে সাথে বুদ্ধি করে ওভেনে লুকিয়ে রেখেছিল ও রিনিতার হার্টটা ।
ওভেন বন্ধ ছিল অবশ্য ।
সুমির চোখে ওই হার্ট পড়লে এতক্ষণে চৌদ্দশিকের মাঝে থাকত নীরব ।
চাচার ব্যাপারটা বুঝে ও । বাবা-মার মৃত্যুকে আর স্বাভাবিক ভাবতে পারে না এখন ।
কোনভাবে ওদের সেই রাতের দুর্ঘটনার জন্য তৌফিক ওমরই দায়ী ।
নীরবকে খুন করে ফেললে পুলিশ সন্দেহ করে বসতে পারে – তাছাড়া সম্পত্তির মালিকানা দাবী করার সময় অপ্রীতিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে পারে তাকে ।
সেজন্য নীরবকে ফাঁসী কাষ্ঠে ঝুলতে দেখতে চায় কুটিল চাচা ।
মনে এইমাত্র জাগা পরের প্রশ্নটা আরও ভয়াবহ রকম ধাক্কা দেয় নীরবকে ।
‘রিনিতার লাশটা গেল কোথায় ?’
সারা বাসায় চক্কর দিতেই সব পরিষ্কার হয়ে যায় ওর কাছে ।
পেছনের দরজাটার কাঁচ ভাঙ্গা । এদিক দিয়ে নবে হাতের নাগাল পেতে পারে যে কেউ – বাসায় ঢুকে পড়া আর কঠিন কিছু নয় তখন ।
একটা তীব্র আতংক চেপে ধরে ওকে ।
খুনী এখনও বাড়ির মধ্যে থাকতে পারে ।
শক্ত করে বাবার পিস্তলটা চেপে ধরে ও ।
প্রথমেই একটা কার্ডবোর্ড দিয়ে ভাঙ্গা গ্লাসটা বন্ধ করে ।
ইচ্ছে করছে পুলিশকে ফোন করতে । নিজের বাসায় এক বিন্দু নিরাপদ নয় ও ।
তবে ওরা আসলে ফেঁসে যাবে নীরবই ।
‘ভালোই খেল দিচ্ছ চাচা মিয়া !’ – মনে মনে তিক্ততা নিয়ে ভাবে নীরব ।
দুইহাতে শক্ত করে পিস্তলটা ধরে প্রতিটি রুম সার্চ করে ও বাসার ।
নীচতলা আর দুইতলার কোন রুমেই কাওকে না দেখে স্বস্তি অনুভব করে ।
মনে পড়ে বেজমেন্টের কথা ।
বেজমেন্টে তেমন কিছু নেই । একটা বড় রেফ্রিজারেটর ছাড়া ।
শীতকালে মাসে একবারই বাজার করতেন নীরবের বাবা ।
এই শহরে শীতের তীব্রতা ভয়াবহ । কাজেই ফ্রিজার ভরে রাখলেই আর বার বার বাইরে যাওয়া লাগত না ।
পা টিপে টিপে বেজমেন্টে নেমে আসে নীরব । হাতে উদ্যত পিস্তল ।
বেজমেন্টটা ঘুটঘুটে অন্ধকার ।
দেওয়াল হাতড়ায় ও একহাতে ।
সুইচবোর্ডটা জানি কোথায় ?
বাবা-মার মৃত্যুর পর এখানে আসা হয় নি আর ।
সুইচ হাতে পেতেই উজ্জ্বল আলোয় ভরে যায় চারপাশটা ।
আৎকে ওঠে নীরব ।
না- বেজমেন্টে কেউ নেই, তবে তুষার শুভ্র দেওয়ালে কালচে হয়ে থাকা রক্তের ছাপটা ঠিকই চোখে পড়ে ওর ।
কাঁপা হাতে বিশাল ফ্রিজারটার ডালা খোলে ও ।
এক হাত কাটা ।
বুকে বিশাল একটা ফোকড় ।
চোখ দুটো বিস্ফোরিত রিনিতার ।
উদগত চিৎকারটা আর ঠেকিয়ে রাখতে পারে না নীরব ।

পরদিন সকাল ।
ফ্রিজ থেকে বের করে শুকনো নাস্তা খেয়ে কলেজের জন্য রেডী হয় নীরব ।
কাল সারা রাত ঘুমাতে পারে নি ও ।
বেজমেন্টে প্রিয় বান্ধবীর লাশ নিয়ে ঘুমানো যায় না ।
রিনিতার লাশটা এখনও ওখানে । ক্লাসে যেতে মোটেও মন চাচ্ছে না ওর ।
তবুও যাওয়া লাগবে ।
নাহলে সন্দেহের মাত্রা আরও বাড়বে ওর সহপাঠীদের মাঝে ।
অবশ্য ক্লাস হবে কি না সে নিয়েই সন্দেহ আছে অনেক । একই কলেজের দুই জন ছাত্র-ছাত্রী মারা যাওয়ার পর অভিভাবকেরা দাবী তুলতেই পারে খুনীকে পাওয়ার আগ পর্যন্ত কলেজ বন্ধ রাখার জন্য ।
শহরটা ছোট ।
তবে কেউ জানে না – খুনী বাইরের কেউ !
এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হাঁটে ও কলেজের দিকে ।
মোড়ের চায়ের দোকানে চোখ পড়তেই হৃৎপিন্ডটা গলার কাছে লাফ দিয়ে ওঠে ওর ।
সুমি ঢুকতেই বাইরে যে মানুষটাকে দেখেছিল – একই মানুষ বসে আছে চায়ের দোকানে !
কেন বসে আছে বলে দিতে হয় না ওকে । এখন নীরবকে পিছু নিয়ে ওকে ফাঁসানোর মত সিচুয়েশনে আরেকটা খুন করতে চলেছে ও নিশ্চয় !
মুখের ভাব পালটায় না নীরব ।
তবে বাসায় বাবার পিস্তলটা রেখে আসায় এই প্রথমবারের মত আফসোস হল ওর ।
ও চায়ের দোকান ছাড়িয়ে যেতেই মানুষটা ওর পিছু নেয় ।
টের পেলেও থামে না নীরব ।
এর শেষ দেখা দরকার । তবে পেছনে ফিরে তাকানো যাবে না
বুঝতে দেওয়া যাবে না নীরবও টের পেয়ে গেছে পুরো ঘটনা ।
তারপর সুযোগ বুঝে চেপে ধরতে হবে ওকে ।
কোনদিকে না তাকিয়ে সামনে হাঁটে নীরব ।
তবে খুব জোরে না – ও চায় না তৌফিক ওমর ওকে হারিয়ে ফেলুক ।
কলেজের গেইটে এসে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না – ঝট করে পিছনে তাকায় ।
কোথাও নেই তৌফিক ওমর ।
পরাজয়ের হতাশা চেপে ধরে ওকে ।
*
বাথরুমের বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে ঘন ঘন চোখেমুখে পানির ঝাপ্টা দেয় নীরব ।
গত একমাস ধরেই শারীরিক বা মানসিক শান্তি বলে কিছু নেই ওর মাঝে ।
প্রথমে বাবা-মার মৃত্যু – তারপর নিজের আত্মহত্যার প্রচেষ্টার ফলে তিনসপ্তাহ হাসপাতালে ।
সেখান থেকে বের হতে না হতেই কুটিল চাচার ষড়যন্ত্রের শিকার ।
মাতালের মত বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই ধাক্কা খেয়েছিল আরেকটু হলেই সুমির সাথে ।
পাশাপাশি দরজা ছেলেদের আর মেয়েদের বাথরুমের ।
‘সরি ।’ টকটকে লাল চোখ মেলে বলে নীরব ।
‘ঠিক আছে । ক্লাসে যাচ্ছ ?’ সুমির চোখও লাল । কান্নাকাটি করেছে অনেক – নিশ্চয় । হয়ত ও-ও গতকাল ঘুমাতে পারেনি ।
‘হুঁ । ক্লাসে যাই । অবশ্য আগে একবার অফিসে যাব । ক্লাসে দেখা হবে ।’ ওকে বলে সামনে হাঁটা দেয় নীরব ।
অফিসে একটা অ্যাপ্লিকেশন জমা দেয়ার কথা ওর ।
মেডিকেল সার্টফিকেট সহ – ওই তিনসপ্তাহ অ্যাবসেন্ট থাকায় যাতে কোন অসুবিধে না হয় সামনে – সেজন্য ।
অফিসরুমটা থেকে বেড়িয়ে আসতেই তীক্ষ্ণ চিৎকারে খান খান হয়ে যায় কলেজের ভাবগম্ভীর নীরবতা ।
মেয়েদের টয়লেট থেকে হিস্ট্রিয়াগ্রস্থের মত বেড়িয়ে আসে সাদিয়া ।
চেঁচিয়ে কলেজ তুলতে থাকা মেয়েটার মুখ থেকে কোন শব্দই বের করা যায় না ।
আশেপাশের শিক্ষকরা ওকে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করেন ।
হাসিনা ম্যাডাম বাথরুমে একবার উঁকি দিয়েই ছুটে ভেতরে ঢুকে যান ।
ভূত দেখে আসার মত চেহারা করে বেরিয়ে এসে বলেন কাঁপা কন্ঠে, ‘সুমির লাশ ভেতরে । কেউ গলা টিপে হত্যা করেছে ওকে । কল দ্য পুলিশ জাফর স্যার ।’
মাথায় বাজ পড়ে নীরবের ।
তবে আশেপাশের কোন কথা কানে যাচ্ছে না ওর তখন । অন্য কিছু ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ।
ভালোমানুষের মত মুখ করে কলেজ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ওর সৎ চাচা – তৌফিক ওমর ।

‘ইউ বাস্টার্ড !’ গলার রগ ছিড়ে চিৎকার দেয় নীরব, ‘ইউ ব্লাডি কোল্ড ব্লাডেড মার্ডারার !’
তীর বেগে ছুটে যায় ও তৌফিক ওমরের দিকে ।
চারপাশ থেকে তাকিয়ে থাকা শিক্ষক-শিক্ষিকার অবাক দৃষ্টির দিকে ভ্রুক্ষেপও করে না ।
চিৎকার কানে গেছে ওমরেরও ।
ছুটতে শুরু করেছে সেও ।
বুলেটের মত কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে নীরব ।
তবুও চাচার চল্লিশ ফিট পেছনে ও ।
রাস্তার মানুষজনের সাথে ধাক্কা খাচ্ছে নীরব – তবুও থামে না এক মুহূর্তও ।
ওর জীবন ধ্বংসকারী মানুষটিকে আজ পেয়ে গেছে হাতের মুঠোয় ।
বুনো মোষের মত ছুটতে থাকে ও ।
দশমিনিট ধরে ছোটার পরও চল্লিশ ফিটের দূরত্ব কমিয়ে কোনমতে বিশফিটে আনতে পেরেছে নীরব ।
বুকের ভেতরটা যেন ফেটে যাচ্ছে অর বাতাসে অভাবে ।
দুর্বিনীত, একরোখা চাচার শারীরিক গঠন ওর চেয়ে ভালো ।
এখনও অবিচল গতিতে ছুটে চলেছে মানুষটা ।
ছুটতে ছুটতে পার্কের কাছে চলে এসেছে ওরা ।
এখানেই সহপাঠী রিফাতকে নিষ্ঠুরের মত হত্যা করেছে লোকটা – ভাবতেই কোথা থেকে জানি আরও একটু শক্তি পায় নীরব ।
বাঘের মত পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ও মানুষটার ওপর ।
দুইজনই গড়িয়ে পড়ে শক্ত মাটিতে ।
চেহারাটা এই প্রথমবার কাছ থেকে দেখতে পায় নীরব ।
সেই চোখ – সেই নাক – না, ও ভোলেনি ওর চাচাকে ।
মনের ঝাল মিটিয়ে দুটো ঘুষি মারে ও সৎ চাচার মুখে ।
তীব্র রাগে আত্মরক্ষার কথা ওর মাথাতেই ছিল না !
সেজন্য ছুটে আসা ঘুষিটা দেখতে পায় না ও – চোয়ালে আছড়ে পড়তেই তৌফিক ওমরের বুক থেকে উড়ে গিয়ে তিনফিট দূরে শক্ত জমিতে পড়ে ও ।
তারপর সব অন্ধকার ।
*
জ্ঞান ফিরে আসতেই নিজেকে সাদা বিছানায় আবিষ্কার করে নীরব ।
চারপাশে তাকিয়ে জায়গাটা চিনতে পারে ।
আগেও ও এখানে ছিল ।
ছোট্ট শহরটার একমাত্র হাসপাতাল ।
তবে এটা প্রাথমিক চিকিৎসা বিভাগ ।
পাশ থেকে হেসে ওর দিকে এগিয়ে আসে নার্স ।
‘জ্ঞান ফিরেছে, নীরব ?’ ওকে আগে থেকেই চেনে মহিলা । ‘তোমার ওপর ফাঁড়া আসতেই আছে । একা একা পার্কের ভেতর গেছ কি মনে করে ? ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলে মনে হয় ?’
‘হুঁ ।’ স্বীকার করে নেয় দ্রুত । আরও ঝামেলা বাড়াতে চায় কে ?
‘সাবধানে থেকো তুমি ।’ মমতাভরা কন্ঠে বলে নার্স, ‘তোমার জন্য আমাদের সবারই চিন্তা হয় । যা যাচ্ছে তোমার ওপর দিয়ে । আর শহরের মানুষও যেন কেমন ! এরপরেও তোমাকে নিয়ে আজেবাজে কথা ছড়ায় । আমি অবশ্য ওসব ছেঁদো কথায় কান দেই না । তোমাকে তো চিনি ।’
মহিলার প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করে ও । মা মারা যাওয়ার পর থেকে এই সুরে কেউ কথা বলে না ওর সাথে ।
আধঘন্টার মধ্যে ছাড়া পায় ও ।
বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে রাত হয়ে গেছে ।
মোবাইল বের করে সময় দেখতে গিয়েও পারে না – চার্জ নেই মোবাইলে ।
বন্ধ হয়ে আছে ।
কাঁধ ঝাঁকায় নীরব । বাসায় গিয়ে চার্জ দিয়ে নিলেই হবে ।
চোয়ালের ডানদিকে সুতীব্র একটা ব্যাথা এখনও আছে । ধাক্কাটা ভালোই লেগেছিল !
নিজেকে গালি দিতে দিতে বাসার দিকে হাঁটে ও ।
প্রায় পেয়েই গেছিল ও সব ঝামেলার মূল হোতাকে ।
রাগের ঠেলায় সব ভন্ডুল করে না ফেললে এতক্ষণে ওকে নিয়ে পুলিশ কাস্টডিতে রেখে আসতে পারত ।
সে জায়গায় নিজেরই ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালে !
পুলিশের কাস্টডিতেও চলে যেতে পারে কাল সকাল নাগাদ ।
এক ঘর ভর্তি টীচারের সামনে দৌড়ে পালিয়েছে ও আজ ; ঠিক যখন সুমির মৃত্যুর কথা উচ্চারণ করেন ম্যাডাম তখনই ।
অন্তত সবার চোখে এমনই লাগার কথা ব্যাপারটা ।
বাসায় ফিরে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে নিজেকে নিরাপদ মনে হয় কিছুটা ।
এখনও ঠিক করেনি রিনিতার ডেডবডি নিয়ে কি করবে – হালকা অস্বস্তি হচ্ছে ওর ।
গা থেকে জ্যাকেটটা খুলে এক কাপ কফি বানায় ।
আগে ও বাইরে থেকে আসলেই মা বানিয়ে দিতেন ।
ভেতরে ভেতরে তীব্র ঘৃণায় ছেয়ে যায় ওর অন্তর । তৌফিক ওমরকে এর পরের বার পেলে আর কিছুতেই ছাড়বে না – মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ও ।
ওমরের কথা মনে পড়তেই ড্রেসারের ড্রয়ার খোলে দ্রুত ।
সাথে পিস্তলটা রাখা দরকার এই সময়গুলোতে ।
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ও সেদিকে ।
পিস্তলটা নেই ।
ছুটে গিয়ে পেছনের দরজাটায় চলে আসে নীরব ।
কার্ডবোর্ডের টুকরোটা কেউ জোর খাটিয়ে ছুটিয়ে ফেলেছে ।
মোবাইলে চার্জ নেই – তবে দোতলায় বাবা-মার ঘরে ফোনটা আছে ।
বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটাচ্ছে । তার মাঝেই ছুটতে ছুটতে দোতলায় ওঠে ও ।
বাবা-মার ঘরে পৌঁছতেই স্থির হয়ে যায় ও ।
বিশাল খাটটার শেষ প্রান্তে বসে আছে তৌফিক ওমর ।
পিস্তলটা সরাসরি ওর বুকের দিকে তাক করা ।
‘বসে পড় ।’ সামনের খালি চেয়ারটা দেখায় লোকটা, ‘কথা আছে ।’


‘তৌফিক ওমর !’ রাগে হিস হিস করে নীরব ।
‘বাহ বাহ !’ খুশি হয়ে ওঠে লোকটা, ‘আমাকে মনে আছে দেখছি !’
‘আমার জীবন ধ্বংসকারী মানুষটাকে ভুলে যাব তা ভাবলেন কি করে ?’ কড়া গলায় বলে নীরব ।
হতাশায় মাথা নাড়ে ওমর, ‘তোমার জীবন রক্ষা করতেই চেয়েছিলাম । সেটাকে জীবন ধ্বংস করা ভাবলে আমি আসলেই দুঃখ পাব । তাছাড়া চেহারা মনে রাখলেও নাম মনে রাখবে – এতদূর ভাবি নি । তোমার বয়স যখন পাঁচ বছর – তখন তোমার সাথে শেষ দেখা আমার ।’
‘এতদিন পরে দেখা করতে এসেছেন নিজের স্বার্থে । নয় কি ?’ হুংকার দিয়ে বলে নীরব ।
কিছু একটা বলে চায় তৌফিক ওমর । তবে তাকে সেই সুযোগ দেয় না নীরব ।
‘থামুন ! আমাকে বলতে দিন ! বিদেশে ঘুরে ঘুরে নিজের সর্বস্ব খুঁইয়েছেন । এরপর এসেছেন সৎ ভাইয়ের সম্পত্তি নিজের করে নিতে । সেদিন রাতে কি হয়েছিল আমি জানি না । কিভাবে কাজটা করেছেন সেটাও আমি জানি না । তবে গাড়ি চালানোতে ভালোই দক্ষ ছিলেন আমার বাবা । এভাবে পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করার মত মানুষ তিনি ছিলেন না । তারপর লেগেছেন আমার পিছে । আমারই সহপাঠীদের খুন করেছেন এমন ভাবে যাতে মনে হয় খুনগুলো আমার করা । সাবাশ, মি. তৌফিক ওমর ! চমৎকার আপনার প্ল্যান ! ’
‘আমার আর তোমার বাবার সম্পর্ক কি ছিল বলে মনে করছ ? ’ রীতিমত অবাক হয়ে বলে তৌফিক ওমর ।
‘খুবই মধুর সম্পর্ক !’ হিস হিস করে বলে নীরব । ‘সৎ ভাইয়ের প্রতি কেমন সম্পর্ক থাকতে পারে ওটা আমাকে বলে দিতে হবে কষ্ট করে ?’
‘তুমি ভুল করছ, নীরব ।’ প্রতিটা শব্দ থেমে থেমে উচ্চারণ করে ওমর । ‘আমি তোমার বাবার সৎ ভাই নই । যিনি ছিলেন তাঁর নাম ছিল ফয়সাল আহমেদ । তিনি মারা গেছেন যখন তোমার বয়স পাঁচ । ’
বিস্ময়ের ধাক্কাটা এতটাই আকস্মিক – কথা হারায় নীরব ।
‘কাগজ কাটার ছুরি দিয়ে তোমার সৎ চাচাকে তুমি জবাই করেছিলে, নীরব ।’ আস্তে করে বলে ওমর । ‘আর ওখানেই আমার দৃশ্যপটে আগমন । আমি তখন ছিলাম তিরিশ বছরের তরুণ সাইকিয়াট্রিস্ট । তোমার বাবার ছোটবেলার বন্ধু । কি করবেন বুঝে না উঠে আমার শরণাপন্ন হন তিনি । যথাসম্ভব ট্রিটমেন্ট দেই আমি তোমার । বিভিন্ন বয়েসে তোমার চাচার ব্যাপারে বিভিন্ন আপডেট দিতে বলি তোমার বাবাকে । তুমি ঘটনাটা ভুলে গেছিলে – সেই সাথে বিভিন্ন সময় সৎ চাচার বিভিন্ন স্থানে থাকার কথা শুনে আপডেট পেয়ে চাচাটি তোমার কাছে জীবিত কেউ হয়ে বেঁচে রইল । তবে ভয়ে ছিলাম তোমার বয়ঃসন্ধিকাল পেরিয়ে গেলেই পাগলামী আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে তোমার ।’
নিজের মানিব্যাগ ছুঁড়ে দেন তিনি ।
বাতাসে লুফে নেয় নীরব ।
একটা ছবিতে দুই বন্ধু গলাগলি করে দাঁড়িয়ে আছেন – তৌফিক ওমর আর নীরবের বাবা ।
আর একটা আইডি কার্ড । মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তৌফিক আলমের । ছবিটাও মিলে যায় ।
সামনে তাকায় নীরব । চোখে শূন্য দৃষ্টি ।
‘তাহলে আমার বাবা মা ?’
‘তুমি সেরাতে ছিলে ওদের সাথে গাড়িতে ।’ আগের মতই মাপা মাপা কন্ঠে বলে চলেন তৌফিক ওমর । ‘এখানে আসার আগ পর্যন্ত বুঝিনি তোমার বাবার মৃত্যু রহস্য । আমি খবরটা শুনে চলে আসি – তোমার পাশে কারও দাঁড়ানোর দরকার মনে করে । তবে এসে শুনি তুমি হাসপাতালে । তোমাদের বাসায় গেছিলাম যখন শুনি তুমি ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েছ । মনে ক্ষীণ একটা সন্দেহ জেগেছিল শুনেই ।’
একটা স্ক্রু-ড্রাইভার বাড়িয়ে দেন তিনি নীরবের দিকে ।
‘এটা পড়ে ছিল তোমাদের বাগানে । কেন ? বাগানে স্ক্রু-ড্রাইভার থাকবে কেন ?’ প্রশ্ন করলেও উত্তরটা তিনি জানেন, বোঝাই গেল, ‘কারণ – সেরাতে গাড়িতে তুমি ওদের সাথে ছিলে । স্ক্রুড্রাইভারটা হাতে মুচড়াচ্ছিলে । হঠাৎ কি যেন হয় তোমার । বাবার ঘাড়ে সম্পূর্ণ স্ক্রু-ড্রাইভারটা ঢুকিয়ে দাও তুমি, নীরব ।’
শুনে থর থর করে কেঁপে ওঠে নীরব । সব মনে পড়ে গেছে ওর সেরাতের কথা । তবে বলে চলেন তৌফিক ওমর ।
‘তারপর দরজা খুলে ঝাঁপ দাও বাইরে । রাস্তায় প্রচন্ড ভাবে ঠুকে যায় তোমার মাথা । এবং গাড়িটা ছুটে যায় খাদের দিকে । তুমি ঠিকই বলেছ নীরব । তোমার বাবাকে আমি প্রায় সারাজীবন ধরে চিনি । এভাবে পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করার মত মানুষ তিনি ছিলেন না । ’
নীরব মুখ খুলে কাঁপা কন্ঠে, ‘তাহলে ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার কথা কেন -’
‘কেন বলল এলাকার সবাই ? তুমি ফেটে যাওয়া মাথা নিয়েই হেঁটে ফিরে এসেছিলে শহরে । বাসা যখন তোমার দৃষ্টি সীমার ভেতর – তখন তোমাকে ফোন করে জানানো হয় তোমার বাবা-মার দুর্ঘটনার কথা । কোনমতে বাগান পর্যন্ত পৌঁছে জ্ঞান হারাও তুমি ।’
‘রিনিতা -’
‘আমি ফলো করছিলাম তোমাকে, নীরব । যাতে আর কোন অঘটন না ঘটাতে পারো । শুক্রবার ব্লাড প্রেশার লো হয়ে যাওয়ার পরও দ্রুত রিকভার করো তুমি । ডাক্তারের শিফটীং টাইম বেছে নিয়ে মেসেজ দাও রিনিতাকে । বাসার দিকে ছুটে আসে রিনিতা । - এটা অবশ্য আমার গেস । কারণ মেসেজ তুমি না পাঠালে ওর আসার টাইমিং নিখুঁত থাকত না ।’
ভুল কিছু বলেন নি ড. তৌফিক ওমর – স্পষ্ট বুঝতে পারে নীরব । সব মনে যাচ্ছে ওর এই ঘটনাটাও ।
‘আমি তোমাকে হাসপাতাল থেকে বের হতে দেখি । দ্রুত ফিরে আসি তোমার বাসায় । কিন্তু রিনিতাকে আসতে দেখলেও তোমায় আসতে দেখি না । নিশ্চয় পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকেছিলে । প্রায় আধঘন্টা খুঁজে পেছনের দরজার কাঁচটা ভাঙ্গা পাই । যতক্ষণে আমি বেজমেন্টে রিনিতার লাশ আবিষ্কার করি তুমি বেরিয়ে গেছ আবার হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ।’
‘আর রিফাতের ব্যাপারটা -’
‘সহজ । পুলিশ স্টেশন থেকে ফিরে আসার সময় তোমাকে মিস করি । নিশ্চয় পার্ক দিয়ে নেমে গেছিলে । পথে পেয়ে যাওয়া পরিচিত মুখ রিফাতকে । ওখানেই শেষ করে দিয়েছ বেচারাকে ।’
‘সুমিকে আমি ওর পেছন থেকে গলা চেপে ধরি - ’ মনে পড়তে ফুঁপিয়ে ওঠে নীরব । ‘ও আমাকে সরাতে চেষ্টা করেছিল অনেক – কিন্তু -’
‘তোমাকে আমি সাহায্য করতে চাই, নীরব ।’ ধীরে ধীরে আবার বলেন ড. তৌফিক ওমর, ‘তোমার ভেতর একসাথে কয়েকটী মানসিক সমস্যা দেখা যায় । খুবই রেয়ার কেইস । অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসর্ডার যেটাকে আমরা OCD বলি – এর তীব্রতম ইফেক্ট হল শর্ট টাইম মেমরি লুজিং । ভায়োলেন্ট হয়ে যাও তুমি অল্প সময়ের জন্য – তবে ভায়োলেন্ট অবস্থা কেটে গেলে তখন আর মনে থাকে না কিছু । আমি তোমাকে এখনও সাহায্য করতে পারি – নীরব । কাম উইদ মি ।’
শূন্য চোখে তাঁর দিকে তাকায় নীরব ।
আস্তে করে মাথা নাড়ায় দুই পাশে ।
ঠিক এক মুহূর্ত আগে তৌফিক ওমর বুঝে ফেলেন কি ঘটতে যাচ্ছে !
‘নো!’ চেঁচিয়ে উঠেন তিনি ।
দেরী হয়ে গেছে ততক্ষণে ।
পুরো স্ক্রু-ড্রাইভারটা নিজের গলায় গাঁথিয়ে দিয়েছে নীরব ।
পিচকিরির মত রক্ত বেরিয়ে আসে ক্ষতস্থান থেকে – ভিজিয়ে দেয় সামনে বসা ওমরের চোখ মুখ ।
অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারেন সাইকিয়াট্রিস্ট – ছেলেটাকে বাঁচানো এখন আর কারো পক্ষেই সম্ভব নয় ।
চিরদিনের জন্য নীরব হয়ে যাচ্ছে নীরব ছেলেটা ।
আর্দ্র চোখে তাকিয়ে দেখেন শুধু তিনি ।
Read More »

Monday, March 20, 2017

অনলাইনে আয় করার সবচেয়ে নিরাপদ ও সহজতম উপায়

অনলাইনে আয় করার সবচেয়ে নিরাপদ ও সহজতম উপায় হচ্ছে বিটকয়েনের মাধ্যমে আয় করা। বিটকয়েন হল লেনদেন হওয়ার সাংকেতিক মুদ্রা। ২০০৮ সালে সাতোশি নাকামোতো এই মুদ্রাব্যবস্থার প্রচলন করেন। তিনি এই মুদ্রাব্যবস্থাকে পিয়ার-টু-পিয়ার লেনদেন নামে অভিহিত করেন। বিটকয়েনের লেনদেনটি বিটকয়েন মাইনার নামে একটি সার্ভার কর্তৃক সুরক্ষিত থাকে। পিয়ার-টু-পিয়ার যোগাযোগ ব্যাবস্থায় যুক্ত থাকা একাধিক কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের মধ্যে বিটকয়েন লেনদেন হলে এর কেন্দ্রীয় সার্ভার ব্যবহারকারীর লেজার হালনাগাদ করে দেয়। একটি লেনদেন সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে নতুন বিটকয়েন উৎপন্ন হয়।

খুব কঠিন মনে হচ্ছে? কোন সমস্যা নাই। এক বিটকয়েন সমান কত ডলার তা জানলেই পাগল হয়ে যাবেন বিটকয়েন আয় করার জন্য। এই লিঙ্ক থেকে দেখে নিন আজকের আপডেটেড রেট।

বিটকয়েন আয় করার জন্য প্রথমেই আপনার প্রয়োজন হবে একটি বিটকয়েন ওয়ালেট , যা আপনি এই লিঙ্ক থেকে সাইন আপ করার মাধ্যমে পেয়ে যাবেন। আপনার ইমেইল আর পাসওয়ার্ড লিখে সাইন আপ করেন। তারপর ইমেইল কনফার্ম করেন। তারপর আপনি একটি বিটকয়েন অ্যাড্রেস পাবেন। এর জন্য বিটকয়েন অ্যাড্রেস ট্যাবে গিয়ে Create New Address এ ক্লিক করলেই পেয়ে যাবেন। ওইটি দিয়ে বিটকয়েন লেনদেন করতে পারবেন। ওয়ালেট তৈরি করা তো হল। এবার আয় শুরু করি।



আয় করার জন্য আপনাকে এই সাইটে একটি একাউন্ট খুলতে হবে তারপর আপনি ফ্রি রোল করে কিছু বিটকয়েন আয় করতে পারবেন। এছাড়া আপনি অন্যকে রেফার করেও আপনার আয় বাড়াতে পারেন। 

আপনার আয়ের পরিমান একটি নির্দিষ্ট পরিমান হলেই আপনি তা আপনার ওয়ালেটে Withdraw করতে পারবেন আর আপনি যদি Auto Withdraw Active করে রাখেন তবে আপনার আয় নির্দিষ্ট পরিমান হলে তা আপনার ওয়ালেটে পাঠিয়ে দেয়া হবে। 

আপনার আয়কৃত বিটকয়েন দিয়ে আপনি মোবাইলে রিচার্জ করতে পারেন এই লিঙ্ক থেকে। আপনি চাইলে বিকাশ অথবা রকেটের মধ্যেও আপনার আয়কৃত বিটকয়েনের সমমূল্যের টাকা নিতে পারেন। এছাড়াও ব্যাংক থেকে ক্যাশ পেতে চাইলে আপনার দরকার একটা okpay, একটা egopay আর একটা payza অ্যাকাউন্ট। আপনি আপনার BTC প্রথমে okpay তে ডিপোজিট করবেন, তারপর okpay থেকে egopay তে withdraw করবেন পুরা ফ্রি তে। তারপর egopay থেকে payza তে withdraw করবেন, এটার জন্নে মাত্র ২% চার্জ কাটবে।

তবে আমি সাধারণত আমার আয়কৃত বিটকয়েন দিয়ে বিদেশি শপিং সাইট থেকে কেনা-কাটা করে থাকি তারপর সেইসব পণ্য দেশে bikroy.com or ekhanei.com এর মাধ্যমে ১০০% লাভে বিক্রি করে থাকি। অর্থাৎ পুরোটাই লাভ !

আপনাদের জন্য কিছু Proof এখানে দেয়া হল : 





Read More »

Wednesday, March 15, 2017

গুডবাই

স্নিগ্ধার হাত ধরে কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকে রিয়াদ ।
আজ রিয়াদের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর বড়ভাইয়ের বিয়ে । চারপাশ নানারকম আলোয় ঝলমলে ।
ওদের দূর থেকেই দেখে ফেলে বন্ধু রাশেদ । এগিয়ে এসে উষ্ণ সম্ভাষণ জানায় ।
‘কিরে ! ভাইয়া তো ঝুলে গেল ।’ স্বভাবসুলভ হাসিখুশি মুখ নিয়ে বলে রাশেদ । ‘তোরা ঝুলবি কবে?’
লজ্জিত হাসি দেয় স্নিগ্ধা ।
‘সামনের বছর, যদি আল্লাহ সব কিছু ঠিক রাখে, দোস্ত ।’ একটু হেসে বলে রিয়াদ । ‘চল, ভাইয়ার সাথে একটু টোকাটুকি করে আসি ।’
হঠাৎ-ই হাসিটা ম্লান হয়ে যায় রিয়াদের মুখ থেকে ।
ওটা তৃণা না ? আরেকটা ছেলের হাত জড়িয়ে থাকতে দেখে ঈষৎ ঈর্ষার খোঁচা অনুভব করে ও বুকের ভেতর । তার থেকেও বেশি জ্বলে ওর ছেলেটার চেহারা দেখে । এই ব্যাটা দেখি একেবারে টম ক্রুজের বাংলাদেশি ভার্সন !
রাশেদদের দিকেই এগিয়ে আসছে ওরা ।
‘হেই রাশেদ !’ কাছাকাছি এসে ডাক দেয় ছেলেটা । ‘তরুণ ভাই আটকে গেছে । ভার্সিটিতে সমস্যা ওদের ।’
‘ড্যাম !’ ঘুরে দাঁড়ায় রাশেদ । ‘বেরিয়ে চলে আসতে বল । দাঁড়াও আমিই ফোন দিচ্ছি ।’
‘উঁহু – ভার্সিটিতে ভয়ানক আন্দোলন চলছে । ভিসি অপসারণের দাবীতে । ভায়োলেন্ট হয়ে উঠেছে পরিবেশ । ছাত্র কল্যান উপদেষ্টা হিসেবে উনি পরিস্থিতি সামলাচ্ছেন । উনার ঘন্টা দুই দেরী হতে পারে ।’
‘কি আর করা ।’ মন খারাপ করে বলে রাশেদ । তরুণ ভাই কাজিনদের মধ্যে সবচেয়ে বড় – জানে রিয়াদ ।
হঠাৎ মনে পরে যাওয়ায় বিব্রত হয় রাশেদ । ‘এই যাহ – পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় নি তোদের ।’ রিয়াদদের বলে ও, ‘কাজিন রেজা এবং হবু ভাবী তৃণা । রেজাকে চিনছ তো ? আর&টি গ্রুপ অফ ইন্ড্রাষ্ট্রিজটা ওরই ।’
‘হবু ভাবী?’ কখন যে জোরে উচ্চারণ করে ফেলে রিয়াদ – নিজেই খেয়াল করে না ।
‘বাগদত্তা ।’ ছাগলের-মত-প্রশ্ন-করিস-কেন টাইপ লুক দেয় রাশেদ ।
একটানে পাঁচ বছর অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায় রিয়াদকে কিছু স্মৃতি ।


তৃণাকে প্রথম দেখে ও ওদের ইউনিভার্সিটির ফ্রেশারস ওয়েলকাম পার্টিতে ।
অসাধারণ সৌন্দর্য আর মার্জিত একটা উপস্থাপনা – এই দুটো জিনিসই প্রধানতঃ আকর্ষিত করে রিয়াদকে ।
ইলেক্ট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী তৃণা । রিয়াদ কম্পিউটার সাইন্সে ।
দূরত্বটা কমিয়ে ফেলার পেছনে ভার্সিটির সবাই কৃতিত্ব দিবে রিয়াদকে । রিয়াদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার কাহিনী ভার্সিটির সব ব্যাচের স্টুডেন্টের কাছেই স্বীকৃত ছিল । অবশেষে দেবীর দয়া হল । আগস্টের আঠার তারিখ তৃণা সম্মতি জানায় রিয়াদকে ।
রিয়াদের জন্য পরের সাড়ে তিনটি বছর ছিল স্বর্গবাসের অভিজ্ঞতা । একসাথে ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়া, ছুটির দিনগুলোতে ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুরে বেড়ানো, সন্ধ্যারাতে ছাদে উঠে গালে গাল ঠেকিয়ে চাঁদ দেখা আর মাসে একবার করে নৌকা ভ্রমণ । পরীক্ষার আগে একজন আরেকজনকে গাইড দেওয়া – কমন কোর্সগুলোর ক্ষেত্রে গ্রুপ স্টাডি – মানে কি একাডেমিক, কি পার্সোনাল – রিয়াদের জীবন তৃণাময় ছিল ।
কিছুটা সমস্যা যে ছিল না তাও নয় – প্রথম একটা বছর আবেগে অন্ধ হয়ে থাকলেও তার পর থেকে ভবিষ্যৎ ভেবে মাঝে মাঝেই চিন্তিত না হয়ে পারত না রিয়াদ ।
রিয়াদের বাবা একজন শিল্পপতি । সমাজের উচ্চস্তরের লোকজনের সাথে তাঁর উঠাবসা । অপরদিকে তৃণার বাবা সামান্য একজন স্কুলশিক্ষক । ন্যায়-নীতি ; মান-মর্যাদার কথা বিবেচনা করে সমাজ তাঁকে অনেক ওপরে স্থান দিতে পারে – কিন্তু নিজের বাবাকে চেনে রিয়াদ । তাঁর পুত্রবধূর পরিচয় দিতে তিনি ‘স্কুলশিক্ষকের’ মেয়ের প্রসঙ্গ কোনদিনই মেনে নেবেন না । স্ট্যাটাস মেইনটেইন করে চলেন তিনি । সমাজের মানদন্ড তাঁর কাছে অর্থ এবং শিক্ষা উভয়ই । পাল্লার দিকে অর্থই হয়ত একটু বেশি ভারী । আত্মীয়তা করার আগে অবশ্যই তিনি ক্লাস এবং স্ট্যাটাসের দিকে নজর দেবেন । তৃণার বাবা যেই মানদন্ডে কোনভাবেই রিয়াদের বাবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে না ।
তারপরেও দিন তো চলে যাচ্ছিল ! যতদিনে না থার্ড ইয়ার সেকেন্ড সেমিস্টারে উঠে ইন্টার-ইউনিভার্সিটি কম্পিটিশনে অংশ নেয় রিয়াদের গ্রুপ । কম্পিটিশনে রিয়াদদের প্রজেক্টই ফার্স্ট হয় – তবে রিয়াদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় কম্পিটিশনটাই । রানার্স আপ গ্রুপের লিডারের দিকে চোখ আটকে যায় রিয়াদের । মেয়েটার কথা বলার মধ্যে আধুনিকতার একটা ছাপ ছিল যেটা তৃণার মাঝে কখনও পায়নি ও । পরিচিত হতে দেরী করে না রিয়াদ । মেয়েটার নাম স্নিগ্ধা ; দেশের প্রথম সারির প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্রী ।
ওখান থেকেই শুরু হয় ওদের বন্ধুত্ব । তৃণার জন্য সময় কমে আসতে থাকে রিয়াদের । স্নিগ্ধাকে তৃণার ব্যাপারে কখনো কিছু জানায় নি রিয়াদ । তাছাড়া স্নিগ্ধার বাবার অবস্থান রিয়াদের বাবার থেকেও একধাপ ওপরে কি না!
একদিন ফোনে তিক্ততার চরমে পৌঁছে যায় রিয়াদ-তৃণার সম্পর্ক । তখন রিয়াদ-স্নিগ্ধা হাতিরঝিলে । স্নিগ্ধা থেকে একটু সরে এসে রিসিভ করে রিয়াদ ।
‘হ্যালো ! রিয়াদ তুমি পাইছটা কি বল তো?’ আহত বাঘিনীর মত হুংকার দেয় তৃণা ।
 ‘কি হয়েছে ? চিল্লাচ্ছ কেন?’
‘তোমার আজ বিকালে আমার সাথে দেখা করার কথা ছিল না ?’
‘ও হ্যাঁ, হঠাৎ নতুন প্রজেক্ট নিয়ে কাজ পড়ে গেল তাই আসতে পারি নি ।’
‘আমাকে দুধের শিশু পাইছ? তুমি ক্যাম্পাস থেকে ওই ডাইনিটার সাথে বের হয়েছ – কি ভেবেছ কিছুই খোঁজ খবর রাখি না আমি ??’
‘মুখ সামলে কথা বল ।’ হঠাৎ-ই মেজাজ চড়ে যায় রিয়াদের ।
‘আমার সাথে তুমি এভাবে কথা বলছ একটা প্রস্টিটিউটের জন্য ? ওর জামাকাপড়ের অবস্থা দেখছ ?’
‘শাট আপ!’ চোখ জ্বলে ওঠে রিয়াদের, চিবিয়ে চিবিয়ে তৃণাকে বলে ও, ‘শা-ট আ-প ! একটা ভদ্রঘরের মেয়ের ব্যাপারে এভাবে কথা বলা তোমার মত মেয়ের মুখে সাজে না । ইটস ওভার, তৃণা । আর কোনদিন আমার সাথে কন্ট্যাক্ট করার চেষ্টা করবে না । ইউর রিয়াদ ইজ ডেড !’ কচ করে লাইনটা কেটে দিয়ে স্নিগ্ধার কাছে ফিরে আসে ও ।
‘সরি - নতুন প্রজেক্টের ব্যাপারে ফোন দিয়েছিল ফ্রেন্ড ।’ বিনীত একটা হাসি দিয়ে বলে রিয়াদ ।
নিজের ইগো ছুঁড়ে ফেলে তৃণা বার বার ক্ষমা চায় রিয়াদের কাছে । স্নিগ্ধার ব্যাপারে করা মন্তব্যের জন্য স্নিগ্ধার কাছে ক্ষমা চাইতেও তার আপত্তি নেই – রিয়াদকে শতবার জানালেও কান দেয় না ও । ততদিনে রিয়াদ – স্নিগ্ধার সম্পর্ক আরও এগিয়েছে কি না ।
অসহায় মেয়েটা এক রাতে এক পাতা স্লিপ পীল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে । বডি রিজেক্ট করে অতিরিক্ত পয়জন । মেডিকেলে রাখা হয় তৃণাকে এক সপ্তাহ । রিয়াদ কিছুই জানতে পারে না । যে রাতে আত্মহত্যার পথই তৃণার কাছে স্বর্গীয় লেগেছিল সে রাতেই রিয়াদ প্রপোজ করছিল স্নিগ্ধাকে । রিলেশনের এক বছরের মধ্যেই বাবাকে তাদের সম্পর্কের কথা জানাতে দ্বিধা করতে হয়নি রিয়াদকে – যে স্থান তৃণা সাড়ে তিনটি বছরেও পায়নি ।
দিন – মাস – করে বছরও পেরিয়ে যায় দুইটি । তৃণা স্মৃতি স্নিগ্ধার আড়ালে হারিয়ে যায় পুরোপুরি ।
*
আজ আবার তৃণাকে সামনে দেখে সব কিছু ওলোট-পালোট হয়ে গেল রিয়াদের । এই কয় বছরে মেয়েটা আরও সুন্দর হয়েছে । স্নিগ্ধাও যথেষ্ট সুন্দরী – কিন্তু আধুনিক পোশাক ছাড়া স্নিগ্ধার সৌন্দর্য্য ম্লান হয়ে যায় – লক্ষ্য করেছে রিয়াদ ।
অথচ তৃণার দিক থেকে বেচারার চোখ সরাতে রীতিমত কষ্ট হচ্ছে । বাঙ্গালী মেয়ের মত শাড়ি পরেই আজ এখানে এসেছে তৃণা – তাতে যেন ওর রূপ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে । আর ঘুরছে কার সাথে দেখো ! আর&টির মালিকের সাথে – সবচেয়ে অল্পবয়সী ধনীদের একজন যে বাংলাদেশে । যে তৃণাকে স্ট্যাটাসের দোহাই দিয়ে একদিন দূরে ঠেলে দিয়েছিল সে এখন তার থেকে দেখতে এবং বিত্তে কয়েকগুণ ওপরের স্তরের ছেলের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে – দৃশ্যটা অসহ্যকর লাগে রিয়াদের ।
একটা টেবিল জুড়ে বসে রাশেদ, তৃণা , রিয়াদ আর স্নিগ্ধা । রেজা তখন পরিচিত এক বন্ধুর সাথে কথা বলতে উঠে গেছে ।
কথা যা বলার ওরা তিনজনই বলছে । রিয়াদ হয়ে গেছে পাথরের মূর্তি ।
অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না ।
‘আমি-ই ওকে ডাম্প করি । দ্যাট ওয়াজ মি !!’ নিজেই নিজেকে বোঝায় ও । কিন্তু কাজ হয় না ।
‘স্নিগ্ধা ভাবীকে তো আপুর সাথে পরিচয় করানোই হল না !’ হঠাৎ মনে পড়ে রাশেদের । ‘তোরা কথা বল । আমরা আপুর সাথে কথা বলে আসি ।’
তৃণা আর রিয়াদ একা এখন । দীর্ঘ দুই বছর পরে ।
‘কেমন আছ তুমি ?’ প্রশ্ন করে রিয়াদ ।
‘ভালো ।’ এতটুকুতে যেন প্রকাশ করতে পারে না তৃণা, ‘জীবনের সবচেয়ে ভালো সময় পার করছি । রেজার মত লাভিং একটা হাজব্যান্ড থেকে বড় চাওয়া একটা মেয়ের আর কি হতে পারে । ওকে দেখে গোমড়া মুখো মনে হচ্ছে না ? আসলে কিন্তু তা না । ভীষণ মজার মানুষ ।’ মুক্তোর মত দাঁত বের করে হাসে তৃণা । সুখী মানুষের হাসি । হঠাৎ লজ্জা পায়, ‘দেখেছ – নিজের কথাই বলে যাচ্ছি ! তোমার কি খবর । শুনলাম তোমাদের নাকি সামনের বছর বিয়ে ? তোমাদের দেখলেই এত হ্যাপী মনে হয় – জানো ? ’
ঠিক আধঘন্টা পর স্নিগ্ধাকে নিয়ে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠে রিয়াদ । রাশেদের সাথে যথেষ্ট খারাপ ব্যাবহারও করে । যথেষ্ট হয়েছে ওর জন্য । পাশের সীটে বসে থাকা স্নিগ্ধাকে রীতিমত বিরক্ত লাগছে এখন ওর ।
তার ওপর কালকে আঠারোই আগস্ট ।
আজকের চাঁদটা সুন্দর । আকাশেও মেঘ নেই ।
গাড়ির জানালা দিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে রিয়াদ – ‘হ্যাপী অ্যানিভার্সারি তৃণা’


ভেতরে একা বসে থাকে তৃণা । বিষন্ন মুখ । রেজা এসে মুখোমুখি বসে । বুলেটের মত প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় -
‘তাহলে এই ছেলের সাথেই প্রেম করতি তুই ইউনিভার্সিটি লাইফে ?’
‘হুঁ’
‘এই শালা তো টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না – তোর কপাল ভালো – এটাই বলব আমি ।’
রাশেদ এসে যোগ দেয় ।
‘অসাধারণ অভিনয়, ইমরান ভাই!!’ পিঠ চাপড়ে দেয় রেজা ওরফে ইমরানের ।
প্রাণ খুলে হাসে ইমরান, ‘আর&টি এর মালিক, মানে- আসল রেজার সাথে গবেটটার দেখা না হলেই হয় ।’
হাসিতে যোগ দেয় তৃণা আর রাশেদও । রাশেদের সাথে হাত মেলায় তৃণা । এখানে ওর কাজ শেষ ।
‘থ্যাংকস এ লট রাশেদ ভাই । থ্যাংকস এ লট ।’
তৃণাকে আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলে রিয়াদ যখন স্নিগ্ধার হাত ধরে দৃশ্যপট থেকে উধাও হয়ে গেছে – তৃণা ছয়টি মাস আচ্ছন্নের মত পার করে । সারাটিদিন ঘরের মধ্যে নিজেকে বন্দী করে ফেলে । তারপর থেকে তৃণার মাথায় প্রতিশোধের চিন্তা ছাড়া আর কিছু কাজ করে না । পার্থিব মর্যাদার দোহাই দিয়ে ওকে ছুঁড়ে ফেলতে পারে যেই ছেলে – তাকে সে দেখিয়ে দেবে তার থেকেও বেশি মর্যাদার কাওকে পেতে পারে ও ।
রিয়াদের ইউনিভার্সিটি লাইফের বন্ধু রাশেদ কোনদিনই রিয়াদের আচরণকে ন্যায় বলে মানতে পারে নি । কাজেই এ ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগীতা দেয় রাশেদ । খালাত ভাই ইমরানকে রেজার ভূমিকায় অভিনয় করার কথা বলতেই সানন্দে রাজি হয়ে যান ইমরান । বোনকে এবং পরিবারকে অসম্মান করে পার পেয়ে যাওয়া ছেলেটার বিরুদ্ধে কাজ করে পাওয়া আনন্দটাকে উপরি হিসেবে গ্রহণ করেন তিনি ।
চাঁদের দিকে তাকায় তৃণা ।
আজকের চাঁদটা সুন্দর । আকাশেও মেঘ নেই ।
বিড় বিড় করে বলে ও, ‘গুডবাই, রিয়াদ ।’
Read More »